শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

চোখের ছানি অপারেশনে নৈরাজ্য লেন্সের দাম নিয়ে কারসাজি

মাহবুব মমতাজী

চোখের ছানি অপারেশনে নৈরাজ্য লেন্সের দাম নিয়ে কারসাজি

দেশে চোখে ছানি পড়া রোগীদের অপারেশনের সময় ইচ্ছামতো দাম রাখা হচ্ছে ইন্ট্রাকুলার কৃত্রিম লেন্স বসানোর ক্ষেত্রে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে মূল্য নির্ধারণের পরও তা মানা না। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কিছু কিছু হাসপাতালে মূল্য তালিকা রাখা হলেও বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালে টানানো হয়নি তা। আর রাজধানীর চক্ষু হাসপাতালগুলোয় চোখের চিকিৎসায় ব্যবহূত লেন্স বিক্রি হচ্ছে অস্বাভাবিক দামে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গেও এ দামের কোনো সঙ্গতি নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আহসান হাবিব নামে এক ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি রাজধানীর ফার্মগেটে একটি চক্ষু হাসপাতালে তার বাবার চোখের ছানি অপারেশন করিয়েছেন। কিন্তু সেখানে তাকে জানানো হয়নি কত টাকা দামের এবং কোন ব্র্যান্ডের লেন্স লাগানো হয়েছে। অথচ অপারেশনে লেন্স লাগানো বাবদ তার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ পাওয়া যায়, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত চোখের চিকিৎসার একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটেও বিভিন্ন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ঠিকমতো সেবা মেলে না সাধারণ রোগীদের ভাগ্যে। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা শহরের হাসপাতালে আলাদা চক্ষু বিভাগ থাকলেও অধিকাংশগুলোয় নেই চিকিৎসক। এতে বাধ্য হয়ে বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে চোখের অপারেশন করাতে যান দরিদ্র রোগীরা। আর সেখানেই নেওয়া হয় একটি সাধারণ লেন্সের দাম কয়েক গুণ বেশি।

দিনাজপুরের বিএনএসবি নামে একটি ক্লিনিকে রাবেয়া খাতুনের বাঁ চোখে ছানি অপারেশন করা হয় গত মাসে। ওই সময় ভালোমানের লেন্স লাগানোর কথা বলে তার কাছ থেকে নেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা। একই এলাকার গাউসুল আজম ক্লিনিকে দুই চোখের ছানি অপারেশন করান সৈয়দ হোসেন। ওই ক্লিনিকে এর জন্য তার খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। অথচ নিবন্ধিত ১৭টি ব্র্যান্ডের লেন্সের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এসব লেন্স বিক্রি করবে দেশের পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। মান বিচারে লেন্সের মূল্য সর্বনিম্ন ১ হাজার ২২৬ থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল্য নির্ধারিত লেন্সগুলো হলো : টেকনিকস ইন্ট্রাকুলার ১১ হাজার ১৯ টাকা, সেন্সার ৭ হাজার ৫৭ টাকা, সেন্সার সোফট ৫ হাজার ৩২৪ টাকা, ইপোচ ১ হাজার ২২৬ টাকা, টেকনিস মাল্টিফোকাল ৫৪ হাজার টাকা, এসিআরওয়াই সোফ ১৪ হাজার ৬৭৮ টাকা, এসিআরওয়াই সোফ মাল্টি ৫ হাজার ৫৯৮ টাকা, এসিআরওয়াই সোফ রেসটেওর মাল্টিফোকাল ৬০ হাজার টাকা, এসিআরওয়াই সোফ টরিক এসটিগমেজম ৩৮ হাজার টাকা, এসিআরওয়াই সোফ এক্রিলিক ৮ হাজার ৯০০ টাকা, ডিজিআর হাইড্রোফোবিক ৬ হাজার ৯০৩ টাকা, একই ব্র্যান্ডের আরেকটির দাম ৪ হাজার ৮৯ টাকা, এক্রিওস ১৩ হাজার ৭২৫ টাকা, একই ব্র্যান্ডের আরেকটির দাম ৫ হাজার ৪৮৯ টাকা, ইএন ভিসটা ১১ হাজার ২৩৩ টাকা, প্রিসাইজাল প্রিলোডেড সোফ ৯ হাজার ৯২৭ টাকা এবং একই ব্র্যান্ডের আরেকটির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৯৮৮ টাকা। জানা গেছে, দেশে বছরে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে দেড় হাজার জনের চোখের ছানি অপারেশন করা হয়। এ হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর চোখের ছানি অপারেশনে লেন্স বসানোর প্রয়োজন হয় ২৪ লাখের। এই রোগীদের কাছেই এসব লেন্স বিক্রিতে আদায় করা হয় অস্বাভাবিক মুনাফা। সে বিষয়ে ঔষধ প্রশাসনের বক্তব্য : সরকারি আইন ও নীতি মেনেই চোখের লেন্সের এমআরপি ঠিক করা হয়েছে। প্রতিটি লেন্সের প্যাকেটে এমআরপি, নিবন্ধন নম্বর, প্রস্তুতকারক দেশের নাম এবং মেয়াদ উল্লেখ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ক্লিনিক মালিকদের হিসাব হলো, চোখের অপারেশনের যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি। সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, ভবন ভাড়া, চিকিৎসকের কমিশন, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন হিসাব করে একটি প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ব্লাইন্ডনেস (আইএপিবি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ রোগীর মধ্যে চোখের ছানির অপারেশন হয় ১ হাজার ৩০০ জনের। অথচ ভারতে এ সংখ্যা ৬ হাজার এবং নেপালে ৩ হজার ৮৪৫। জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) রুহুল আমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চোখের লেন্সের মূল্য তালিকা প্রতিটি হাসপাতালে টানানোর ব্যবস্থা করেছি। পরে তা যাচাই করেও দেখা হয়েছে। এর পরও যদি কারও কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য নেওয়া হয়, ভুক্তভোগীরা যদি ক্যাশমেমোসহ আমাদের কাছে অভিযোগ করেন সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর