মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

পানিবন্দী কয়েক লাখ মানুষ বাড়ছে দুর্ভোগ

প্রতিদিন ডেস্ক

টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাকালুকি হাওর পাড়ের লক্ষাধিক মানুষ। হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে কুলাউড়া জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম। সিলেটের সাতটি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। ৭ উপজেলার অন্তত ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়া ও বান্দরবানের লামা-আলীকদমের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চার উপজেলার অন্তত অর্ধশত গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী। অনেকে আশ্রয় নিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ও বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। গতকাল বিভিন্ন স্থানে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষ সরকারি ত্রাণসহায়তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে মানুষের। এদিকে প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণাবর্তের কারণে সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে ১০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন বাঁধে ফের ধস নেমেছে।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর : সিলেট : সাত উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কিছু কিছু স্থানে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এসব এলাকায় অন্তত ৩ লাখ পানিবন্দী মানুষ রয়েছে চরম দুর্ভোগে। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বাড়ছে পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপ। এদিকে কুশিয়ারা নদীর বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের অনেক স্থানেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ওসমানীনগর, গোলাপগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গতকাল কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল পানি। গতকাল সরেজমিন বিয়ানীবাজারে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার দশটি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই বন্যাকবলিত। বন্যাদুর্গত মানুষ জানান, গতকাল থেকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সরেজমিন বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় গিয়েও একই অবস্থা দেখা গেছে। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে উপজেলা পরিষদ, ডাকবাংলো, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও। এদিকে বন্যায় নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য সংকটও তীব্র হয়ে উঠছে। ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগ। বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছেই। এলাকার বিভিন্ন ইউনিয়ন অফিসে ত্রাণের জন্য অসহায় মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। মৌলভীবাজার : পানিবন্দী হয়েছেন হাকালুকি হাওর পাড়ের লক্ষাধিক মানুষ। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে কুলাউড়া জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম। অপরিবর্তিত রয়েছে হাওরের পানি। ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে মানুষের। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ও বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্ধ রয়েছে কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা কলেজসহ প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা না পেয়ে দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে দুর্গত মানুষ। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে হাকালুকি হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এর মধ্যে পানি কিছুটা কমে ছিল। কিন্তু ভারি বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে আবারও পানি বেড়ে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কিছু বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট। ভোগান্তিতে পড়েছেন হাওর পাড়ের লক্ষাধিক মানুষ। কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। পৌরসভা এলাকার বিহালা, সোনাপুর, বিছনাকান্দি এলাকায় মানুষের ঘরে হাঁটুপানি। এ ছাড়া উপজেলার বরমচাল, ভাটেরা, কাদিপুর ও জয়চণ্ডি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ও সদর ইউনিয়নের অন্তত ১০ গ্রামের মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসায় অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে। বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওর-সংলগ্ন বর্ণি, তালিমপুর, সুজানগর ও দাসেরবাজার ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকার অন্তত ৪০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী। এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষ অভিযোগ করেছেন, তারা সরকারি ত্রাণসহায়তা পাচ্ছেন না। সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আজিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাকালুকি উচ্চবিদ্যালয় ও দ্বিতীয়ারদেহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। বড়লেখার তালিমপুর এলাকার বাসিন্দা বশির মিয়া বলেন, ‘বন্যার পানিতে ঘর অর্ধেক ডুবে গেছে। এখনো পানি কমার কোনো লক্ষণ দেখছি না। এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণসহায়তা পাইনি। বড়লেখার তালিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শ্রীকান্ত দাস জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এখন দুর্গত মানুষের পর্যাপ্ত ত্রাণ দরকার। কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বি জানান, বন্যাকবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিজিএফ চাল বিতরণ করা হচ্ছে। নগদ অর্থও বিতরণ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি না কমায় হাওর থেকে পানি বের হতে পারছে না। দুর্গত মানুষের মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার, স্যালাইন, নগদ অর্থ ও চাল দেওয়া হয়েছে। চকরিয়া : টানা দুই দিনের বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়া এবং বান্দরবানের লামা-আলীকদমের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চার উপজেলার অন্তত অর্ধশত গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। লামা-আলীকদম সড়কের দুটি অংশের ওপর দিয়ে ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। চকরিয়ার অভ্যন্তরীণ বেশ কয়েকটি গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গতকাল মাতামুহুরী নদীর চিরিঙ্গা পয়েন্টে ঢলের পানি বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। রবিবার ও গতকালের টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি মাতামুহুরী নদীর দুই কূল উপচিয়ে বসতি এলাকায় প্রবেশ করে। গতকাল দুপুর থেকেই ঢলের পানি বাড়তে থাকে চকরিয়া-পেকুয়ায়। সকালে পার্বত্য উপজেলা লামা-আলীকদমের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। লামা-আলীকদম সড়কের দুটি অংশের ওপর দিয়ে ঢলের পানি প্রবাহিত হয়। চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, কৈয়ারবিল, পৌরসভার একাংশ, সাহারবিল ও পেকুয়ার মগনামা, উজানটিয়ার বেশির ভাগ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ : প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণাবর্তের কারণে চৌহালীতে ১০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন বাঁধে ফের ধস নেমেছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার খাসকাউলিয়া ইউপির আজিমুদ্দীন মোড়ে আকস্মিক ধসে প্রায় ৮৫ মিটার এলাকা বিলীন হয়ে যায়। এদিকে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই বাঁধটিতে দফায় দফায় ধস দেখা দেওয়ায় নদী তীরবর্তী মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুর মোহাম্মদ চৌধুরী সঞ্জু জানান, নির্মাণ কাজে ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে বার বার এ ধস নামছে। সরকার চৌহালী রক্ষায় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে কাজ না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি। চৌহালী রক্ষা বাঁধের তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ জানান, যমুনার পানি বৃদ্ধি ও প্রবল স্রোতে স্কাউরিংয়ের ফলে আজিমুদ্দীন মোড়ে আঘাত হানায় বাঁধের তলদেশে গর্তের সৃষ্টি হয়ে এ ধস দেখা দিয়েছে। তবে আতঙ্কের কিছুই নেই।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়া : সরাইল উপজেলার পানিশ্বরে মেঘনা নদীর ভাঙনে ৬টি চাতাল মিল ও চারটি বসতঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। শনিবার বিকাল থেকে ভাঙন শুরু হয়। অব্যাহত ভাঙনে চাতাল মিলগুলোর আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগীরা জানান, বৃষ্টির কারণে মেঘনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শনিবার বিকাল ৩টায় পানিশ্বর ইউনিয়নের শাখাইতি গ্রামের চাতাল মিলগুলো নদীগর্ভে বিলীন হতে শুরু করে। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে নদীপাড়ের পাল সম্প্রদায়ের সুনিল সূত্রধর, হরিদাস সূত্রধর, শঙ্কর সূত্রধর ও দুলাল সূত্রধরের বসতঘর। ঘর হারিয়ে তারা এখন প্রতিবেশীদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। পানিশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. দীন ইসলাম বলেন, নদী ভাঙনের কারণে আমাদের মূল পানিশ্বর গ্রাম বিলুপ্তপ্রায়। ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা না করলে আমাদের দুর্ভোগ শেষ হবে না। সরাইল উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা মেঘনা নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস দেন।

সর্বশেষ খবর