মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

টাকা ছাড়া মেলে না কোনো সেবাই

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

টাকা ছাড়া মেলে না কোনো সেবাই

পাবনা বিবি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামে বিপ্লব কুমার বিশ্বাস নামে এক ছাত্র এ বছর উত্তীর্ণ হন। ফলাফল ৪.০০ পেয়ে মহাখুশি বিপ্লব। কিন্তু খুশিতে বাদ সেধেছে সার্টিফিকেটের ভুল। এ ভুল জন্ম তারিখে। ওই স্কুলের অফিস কেরানিকে বিষয়টি জানালে সংশোধন করে দেবে বলে জানান। কিন্তু দুই মাস ঘোরানোর পর অপারগতা জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার টঙ্গীতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড অফিসে গিয়ে সংশোধন করা যাবে। বিপ্লবের টাকার টাকাও গেছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এদিকে বিপ্লব গত বৃহস্পতিবার সেই পাবনা থেকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড অফিসে আসেন। কিন্তু সেদিন কোনো কাজ হয়নি। অপেক্ষা করতে হয়েছে রবিবারের জন্য। রবিবার সকাল ১০টার দিকে এসে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি জানতে পারেন সাড়ে তিন মাস সময় লাগবে সংশোধিত সার্টিফিকেট পেতে। বিপ্লব ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ভাই সেই পাবনা থেকে এসেছি। এতদূর থেকে আসছি তার কোনো গুরুত্ব নেই এদের কাছে। আবার আসতে হবে একই কাজে। শুধু বিপ্লবই নন, এমন অভিযোগ করেন মানিকগঞ্জ থেকে আসা আরিফ, ধানমন্ডি থেকে আসা নাসেরসহ অনেকে। গাজীপুরের শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজের ছাত্র শামীম আহমেদ বলেন, ১১ বিষয়ের জায়গায় ১৪ বিষয় পরীক্ষা দিয়েছি। তারপরও পরীক্ষায় অনুপস্থিত দেওয়া হয়েছে। গাজীপুর আঞ্চলিক কেন্দ্রে গিয়েও এর কোনো সমাধান পাইনি। এমন চিত্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও। চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীরা এর সমাধানের জন্য অনশনও করেন।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১২-১৩ সেশনে এসএসসিতে ভর্তি ফি ছিল মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা। আর এখন ভর্তিতে লাগে ৪ হাজার টাকা। শুধু ৪ হাজার টাকায়-ই সব শেষ হয় না, লাগে আরও অতিরিক্ত টাকাও। এমন চিত্র এইচএসসির ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে ডিগ্রির বেলায় যেখানে ছিল ৩ হাজার টাকা। এখন দিতে হয় ৬ হাজার টাকারও বেশি। আর এভাবেই ফির নামে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফুলে-ফেঁপে উঠছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর এসব অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য ভর্তি হতে এখন আর আগের মতো আগ্রহ নেই ছাত্রদের। অনেকটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হুট করে নিয়ম পাল্টানো শুরু হয়েছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যদিকে ডিগ্রির ছাত্রদের কাছ থেকে প্লাস্টিক আইডি কার্ড দেওয়ার কথা বলে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হলেও প্লাস্টিক আইডি কার্ড এখনো পায়নি শিক্ষার্থীরা। গত রবিবার সরেজমিন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্টুডেন্ট কর্নার (পুরুষ) ও স্টুডেন্ট কর্নার (মহিলা) কক্ষে অর্ধশতাধিক ছাত্রছাত্রী অপেক্ষা করছেন। কথা হয় মধ্যবয়সী হারিছ মিয়া নামে এক ছাত্রের সঙ্গে। তিনি বলেন, বেসরকারি একটি চাকরি করি। কিন্তু ডিগ্রির সার্টিফিকেটের জন্য চাকরিতে প্রমোশন হচ্ছে না। তাই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি করতে ভর্তি হই। পরীক্ষাও দিই যথাসময়ে। কিন্তু ফলাফলে আমার নামের বানান ভুল এসেছে। সংশোধন করতে এসেছি সেই কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থেকে। কিন্তু এখানে এসে পড়েছি নানা সমস্যায়। টাকা ছাড়া এখানে কেউ কাজ করে না। আমাদের সুবিধার জন্য সরকার এই প্রতিষ্ঠান গড়েছে। অথচ এখানে আমাদের সুবিধার চেয়ে সুবিধা এখানে দায়িত্বরতদের। এরা যে যার মতো করে অফিসে আসে। দু-একজনের কথা শুনে চলে যায় লাঞ্চে (দুপুরের খাবার)। আর লাঞ্চের পর তো কোনো কাজই হয় না।

অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রদের পরীক্ষায় অনুপস্থিত রাখা আঞ্চলিক কেন্দ্র ও পরীক্ষা কেন্দ্র যোগসাজশে করে আসছে। আর এর পেছনের কারণ নাকি পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন না করা। জানা যায়, পরীক্ষা শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই ছাত্রদের তালিকা ধরে ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা উত্তোলন করা হয়। আর এসব উত্তোলিত টাকা পরীক্ষায় দায়িত্বরত শিক্ষক, আঞ্চলিক কেন্দ্রের ইনচার্জ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা পরীক্ষা তদারক (ম্যাজিস্ট্রেট) সবাই পেয়ে থাকেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ সুবিধা থেকে বাদ যাননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরের ধলাদিয়া কলেজ, পিয়ার আলী কলেজ, শ্রীপুর কলেজ, চন্দ্রা জাতির পিতা ডিগ্রি কলেজ গাজীপুর উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে দেওয়ার কথা বলে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, পরীক্ষায় সব ধরনের নকল সার্ভিসও দিয়ে আসছে এসব কলেজ। তবে এসব বিষয়ে বাংলাদেশ উন্মুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, কিছু অনিয়মের কথা শুনেছি। পরবর্তীতে যেন আর এমন না হয় তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাত্ররা অভিযোগ করেন, ঢাকা ও আশপাশ শহরের নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রিতে ভর্তির সময় আসন সংকট দেখানো হয়। কিন্তু আঞ্চলিক কেন্দ্রে কর্মরতদের অতিরিক্ত টাকা দিলেই আসন পাওয়া যায়। সরেজমিন গাজীপুর উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করছেন। এদের কেউ বই নিতে এসেছেন। কেউ এসেছেন সংশোধনী করতে। আবার কেউ টাকা জমা দিতে। কিন্তু সকাল ১০টা থেকে ছাত্রদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হলেও ঘড়ির কাঁটা ঠিক ১২টায় পৌঁছলে বন্ধ হয়ে যায় সব সার্ভিস। ১২টার পর এই উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়ারে বসে ঝিমাতে দেখা যায়। জানতে চাইলে গাজীপুর উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রের ডেপুটি জোনাল ডিরেক্টর মো. আমিনুল ইসলাম রাগতস্বরে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি কোন পত্রিকার সাংবাদিক। আমার ভাইও সাংবাদিক। এখানে কোনো অনিয়ম-টনিয়ম নেই।’ অভিযোগ রয়েছে, এই উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতিরিক্ত বাইরের (বহিরাগত) লোক কাজ করেন। আর এসব বাইরের লোকদের বেতন দিতে নাকি ছাত্রদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। এখানে টাকা জমার রসিদ নিলেও অতিরিক্ত ৫০-১০০ টাকা দিতে হয়। পাঠ্যবই নিতেও অতিরিক্ত টাকা লাগে। মোটের ওপর যে কোনো সেবা-সুবিধা নিতে হলেই অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রের অফিস সহকারী দুলাল বলেন, ছাত্ররা খুশি হয়ে মাঝে-মধ্যে ৫০-১০০ টাকা দেয়। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বিভিন্ন বিষয়ে আর্থিক লেনদেন হয়নি বলে দাবি করেন। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত আর্থিক লেনদেনের খবর পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তবে আমি যোগদানের পর থেকে এসব কমে গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর