বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্যায় পানিবন্দী লাখো মানুষ

ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

প্রতিদিন ডেস্ক

বন্যায় পানিবন্দী লাখো মানুষ

ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর উজান থেকে আসা পানির কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন জেলায় নদ-নদীর পানি বেড়েছে। বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। এ ছাড়া অনেক জেলায় নদীর ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে সিলেট। এ ছাড়া মৌলভীবাজার ও বান্দরবানেও বন্যা পানিবন্দী করে রেখেছে সেখানকার মানুষকে। ভাঙনের কবলে পড়েছে খাগড়াছড়ির নদীপাড়ের মানুষ। নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

সিলেট : ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে জেলার আটটি উপজেলায় দীর্ঘমেয়াদি বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় এসব উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত ছিল। সিলেটে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বিশেষ সভা গতকাল বিকালে অনুষ্ঠিত হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় জানানো হয়, বন্যায় সিলেটের আটটি উপজেলায় ৫৫টি ইউনিয়ন পরিষদের ৪৬৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৮৪৭টি পরিবার। বন্যায় চার হাজার ৩৩০ হেক্টর আউশ ধান ও ৩৫ হেক্টর আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিলেটের বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য ১১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৪৫টি পরিবারের ৬২৯ জন আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিমধ্যে বন্যার্তদের সহায়তায় ১২৭ মেট্রিক টন চাল ও নগদ তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গতকাল সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে আরও ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দেন মন্ত্রী মায়া। এদিকে সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বেশ কয়েকটি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এসব টিমের মাধ্যমে খাওয়ার পানি বিশুদ্ধ করার এক লাখ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যার্তদের ওরস্যালাইনও প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে আরও এক লাখ ৪৭ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও এক লাখ ওরস্যালাইন মজুদ রয়েছে। প্রয়োজনে এগুলো বন্যাকবলিত এলাকায় বিতরণ করা হবে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) সূত্র জানায়, বন্যায় সওজের তিনটি সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়কের ছয় কিলোমিটার পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। পানি সরে গেলে এসব সড়ক যাতে দ্রুত সংস্কার করা যায় সে জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। মৌলভীবাজার : গেল বোরো মৌসুমে অকালবন্যায় তলিয়ে যাওয়া ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই এবার পানিবন্দী হয়েছেন হাকালুকি হাওর পাড়ের লক্ষাধিক মানুষ। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে কুলাউড়া, জুড়ি ও বড়লেখা উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম। অবশ্য গতকাল থেকে ধীর গতিতে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে দুর্ভোগ রয়ে গেছে হাওরের পানিবন্দী মানুষের। বন্যার কারণে বাড়িঘর ছেড়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ও বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যাবস্থা। বন্ধ রয়েছে কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা কলেজসহ  প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক  বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান। পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে কষ্টে আছেন দুর্গত মানুষ। মৌলভীবাজারে দুই সপ্তাহ আগে হাকালুকি হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এর মধ্যে পানি কিছুটা কমেছিল। কিন্তু ভারী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে কয়েক দিন ধরে আবারও পানি বেড়ে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কিছু বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট। সরেজমিনে দেখা যায়, কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের ৯০ শতাংশ মানুষের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। পৌরসভা এলাকার বিহালা, সোনাপুর, বিছরাকান্দি এলাকায় ঘরে হাঁটুপানি। এ ছাড়া উপজেলার বরমচাল, ভাটেরা, কাদিপুর ও জয়চণ্ডি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। জুড়ি উপজেলার জায়ফরনগর ও সদর ইউনিয়নের অন্তত ১০ গ্রামের মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসার অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে। আবার কোনো আশ্রয় না থাকায় আসবাবপত্র, গবাদিপশু নিয়ে উঁচু সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন দুর্গত অনেক মানুষ। বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওর-সংলগ্ন বর্ণি, তালিমপুর, সুজানগর ও দাসেরবাজার ইউনিয়নসহ আশপাশ এলাকার অন্তত ৪০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী। এর মধ্যে সুজানগর ইউনিয়নের দশঘরি, রাঙ্গিনগর, বাড্ডা, ঝগড়ি, পাটনা, ভোলারকান্দি, উত্তর বাঘমারা; তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা, ইসলামপুর, কুটাউরা, বাড্ডা, নুনুয়া, পাবিজুরি, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, পশ্চিম গগড়া, পূর্ব গগড়া, বড় ময়দান, গাগড়াকান্দি, তেলিমেলি, গোপালপুর, হাউদপুর; বর্ণি ইউনিয়নের পাকশাইল, সত্পুর, কাজিরবন্দ, নোওয়াগাঁও, উজিরপুর, দাসেরবাজার ইউনিয়নের চানপুর, অহিরকুঞ্জি, উত্তর বাগিরপাড়, দক্ষিণ বাগিরপাড়, পানিশাইল, ধর্মদেহী, চুলারকুড়ি, কোদালী, ধলিরপাড়, নেরাকান্দি, মাইজমজুড়ি, মালিশ্রী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বান্দরবান : তিন দিনের টানা ভারী বর্ষণের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানের লামা পৌর এলাকাসহ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের নিচু এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। মাতামুহুরী নদী, লামা খাল, ইয়াংছা খাল, বগাইছড়ি খাল ও পোপা খালসহ বিভিন্ন স্থানের পাহাড়ি ঝিরিগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে এখানকার প্রায় ১০ হাজার মানুষ। কর্মহীন হয়ে বেকায়দায় পড়েছের শ্রমজীবীরা। টানা বৃষ্টির কারণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসও দেখা দিয়েছে। বর্ষণের পানির স্রোতে সড়ক ভেঙে ও সড়কের ওপর পাহাড় ধসে পড়ে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সোমবার সন্ধ্যা নাগাদ মাতামহুরী নদীর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করেছে। পাহাড়ধসের কারণে বান্দরবান সদরের সঙ্গে রুমা উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভারী বর্ষণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানের পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কায় জেলা প্রশাসন, লামা পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর পক্ষ থেকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার জন্য দফায় দফায় তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বন্যাকবলিতদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের কোয়ার্টার খুলে দেওয়া হয়েছে। টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ বন্যাসহ পাহাড়ধসে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। শরীয়তপুর : পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙন শুরু হয়েছে। গত সাত দিনে ভাঙনে শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার দুটি গ্রামের ১৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে আঙ্কিত হয়ে পড়েছে গ্রাম দুটির আরও দেড় হাজার পরিবার। আতঙ্কিত মানুষ তাদের বসতঘরের আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, গত সাত দিনে পদ্মান দীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পদ্মা নদীতে স্রোত প্রবল হয়েছে। আর স্রোতের কারণে শুরু হয়েছে ভাঙন। শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুণ্ডের চর ইউনিয়নের কলমিরচর গ্রাম ও নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে গ্রাম দুটির ১৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে আরও ১৫০০ পরিবার। কলমিরচর ও ঈশ্বরকাঠি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো তাদের বসতঘরের আসবাবপত্র সরিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ বাড়ির আঙিনায় থাকা গাছ কেটে নিচ্ছে। পরিবারগুলো কোথাও আশ্রয় না পেয়ে পাশের গ্রামগুলোর ফসলি জমিতে খোলা আকাশের নিচে, কেউ কেউ ছাপড়া তুলে থাকছে। ভাঙন আতঙ্কে থাকা পরিবারগুলোও তাদের বসতঘরও সরিয়ে নিচ্ছে। খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়িতে চেঙ্গী, মাইনি ও রামগড়ের ফেনী নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে গ্রাম, বিস্তীর্ণ জনপদ, ফসলি জমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্ষা মৌসুমে ইতিমধ্যে ৫০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। খাগড়াছড়ির চেঙ্গী ও দীঘিনালার মাইনি নদীর ভাঙনে দুই পাড়ের বহু পরিবার   বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। প্রতিবছর বর্ষার মৌসুমে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী ও মাইনি নদীর ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয় বহু এলাকা। এ সময় আতঙ্কে থাকে নদীপাড়ের  পরিবারগুলো। এবার ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়েছে   বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।

সর্বশেষ খবর