শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্যায় বাড়ছে পানি বাড়ছে দুর্ভোগ

প্রতিদিন ডেস্ক

বন্যায় বাড়ছে পানি বাড়ছে দুর্ভোগ

কুড়িগ্রাম যাত্রাপুর ইউনিয়নের খেয়ার আলগার চরে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে মানুষজনের —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের উত্তরাঞ্চল কুড়িগ্রামে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে দুর্ভোগ। তবে কোনো কোনো এলাকায় পানি কমতেও শুরু করেছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

বান্দরবান : বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসায় গতকাল বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ায় নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও আলীকদমে সড়ক যোগাযোগ অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। বসতভিটা থেকেও বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে কিছু নিম্নাঞ্চল এখনো প্লাবিত রয়েছে। এ অবস্থায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে অনেকেই নিজেদের বাড়ি ফিরে বন্যা-পরবর্তী জমে থাকা পলি ও ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে লেগে গেছেন।

লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খিন ওয়ান নু জানান, বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও মাতামুহুরী নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আলীকদম উপজেলায়ও বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বন্যাকবলিত লোকজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন।

আরেক খবরে জানা গেছে, গতকাল পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে পাহাড়ধসে চমেন খাতুন (৪৪) নামে এক নারী নিহত হয়েছেন। এ সময় তার ছোট মেয়ে আমেনা খাতুন আহত হয়। গভীর রাতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের আজু খাইয়া এলাকার      ফকিরপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ১৩ জুনও ভারি বর্ষণে বান্দরবানে পাহাড়ধসে নিহত হয়েছিলেন ৯ জন।

চকরিয়া : গতকাল কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়ার বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। চকরিয়ার সিংহভাগ এলাকার পানি কমতে শুরু করেছে। অবশ্য চোয়ারফাঁড়ি, কোরালখালী, ঢেমুশিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় নতুন করে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। প্লাবিত এলাকার মধ্যে কাকারার ১ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বপাড়ায় গতকাল সন্ধ্যায়ও বুক পরিমাণ পানি ছিল। একই অবস্থা রয়েছে নিকটবর্তী ইউনিয়ন লক্ষ্যারচরের উত্তর লক্ষ্যারচর, বাইন্যারকুম, কৈয়ারবিলের ভরইন্যারচর, সিতারখীল, পৌরসভার বিনামারা, পালাকাটার একাংশ, আমাইন্যারচর, পৌরসভার শমসেরপাড়া, জালিয়াপাড়া, স্কুলপাড়া, নিজপানখালী, বরইতলীর গৌবিন্দপুর, জেলেপাড়াসহ অর্ধশতাধিক পাড়ায়। বাইশ্যারচরা খাল, নলবিলা খাল, সোনাইছড়ি ও হারবাং ছড়া খাল খনন না হওয়ায় ওইসব এলাকার লোকজন পানিবন্দী হয়ে আছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, ডুলাহাজারা, ফাঁসিয়াখালী, চিরিংগা, খুটাখালী ও পৌরসভা থেকে পানি অনেকাংশে নেমে গেছে। কিন্তু চকরিয়া-কাকারা-মানিকপুর সড়কের বিভিন্ন স্থানে এখনো পানি রয়েছে। ফলে যান চলাচল এখনো স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি। দেখা গেছে, যেখানেই পানি কমছে সেখানেই কার্পেটিং, ব্রিক সলিং ও কাঁচা রাস্তার ক্ষতবিক্ষত চিত্র ভেসে উঠছে। কোনো বসতঘরেরই ঘেরা-বেড়া নেই। সবকিছু ভেসে গেছে। হাজার হাজার পরিবারের ঘরের আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। বন্যার কারণে চকরিয়া ও পেকুয়ার ৭০ শতাংশ টিউবওয়েলের পানি পান-অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে চকরিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কামাল হোছাইন জানান। চকরিয়া উপজেলার সাহারবিল, পূর্ব-বড়ভেওলা, বিএমচর, কোনাখালী, পশ্চিম-বড়ভেওলা, ঢেমুশিয়া এলাকায় বানের পানি এখনো কমেনি। চকরিয়া-বদরখালী-মহেশখালী সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি রাস্তা দিয়ে পারাপার করছে। পেকুয়ার শিলখালী, বারবাকিয়া ও টৈটং-এ পানি কমে গেছে।

কক্সবাজার : কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা অপরিবর্তিত রয়েছে। পাহাড়ি ঢলে জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি বেড়েছে। তবে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় কিছু কিছু উঁচু এলাকা থেকে বন্যার পানি নিচু এলাকার দিকে নেমে যাচ্ছে। এতে নিম্নাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। প্রধান প্রধান সড়কের ওপর থেকে পানি নেমে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। জেলার প্রধান দুটি নদী মাতামুহুরী ও বাঁকখালীর পানি বিপদসীমার অন্তত ৪ ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখনো তলিয়ে আছে জেলা সদর, চকরিয়া, পেকুয়া ও রামুসহ জেলার দেড় শতাধিক গ্রাম। এখনো পানিবন্দী অন্তত ৪ লক্ষাধিক মানুষ। মাতামুহুরী নদীর উভয়পাশে গ্রামগুলোতে অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। বাঁকখালী নদীর উভয়পাশে অন্তত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী।

এদিকে বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে গতকালও দুই সহোদরসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। রামুর ফতেখারকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম জানান, দুপুরে রামু উপজেলার ফতেখারকুল ইউনিয়নের কামাল হোসেনের দুই পুত্র শাহীন ও ফামিন বন্যার পানিতে ডুবে বাঁকখালী নদীতে ভেসে যায়। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া পাহাড়ধসে গতকাল সন্ধ্যায় উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়ার সরওয়ারের শিশুপুত্র সাব্বির ও গত মঙ্গলবার মহেশখালী উপজেলার হোয়ানকে মোনার আলমের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ি ঢলে মঙ্গলবার ঈদগাঁওতেও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

টেকনাফ (কক্সবাজার) : টেকনাফে টানা বর্ষণের ফলে পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে হাজারো পরিবার। পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারগুলো ঢালু কিংবা খাড়া অংশের নিচে বাড়ি-ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। টেকনাফ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা তাপস কুমার দেব জানান, কয়েক দিনের ভারি বর্ষণের ফলে পাহাড়ে বাসকারীদের নিজ দায়িত্বে সরে যেতে মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে। টেকনাফ উপজেলায় পাহাড়ের মধ্যে ২৫টি পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় চার শতাধিক পরিবার অধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করলেও টানা বৃষ্টিপাতে কেউ নিরাপদ নয়। তাই সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। 

সিলেট : সিলেটের আট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে। গতকাল সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। খাদ্য সংকট, বিশুদ্ধ পানি সংকট ছাড়াও বন্যার্তদের মধ্যে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। ডায়রিয়া, পেটব্যথা, নিউমোনিয়া, জ্বরসহ নানা রোগে ভুগছেন মানুষ। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে রোগের প্রকোপ বেশি। সিলেট জেলা প্রশাসন ত্রাণের বরাদ্দ বাড়ালেও বন্যার্ত সব মানুষের হাতে পৌঁছাচ্ছে না। সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার বন্যাকবলিত সব উপজেলায় ৪টি করে মেডিকেল টিম গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। গতকাল দুপুরে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, বন্যাদুর্গত এলাকায় ৭৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারের হাকালুকি পাড়ে ধীরগতিতে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে দুর্ভোগ কমেনি মানুষের। ত্রাণের জন্য এখনো হাহাকার আছে দুর্গত মানুষের মধ্যে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ।  মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. সত্যকাম চক্রবর্তী জানান, তারা যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি আছেন, তবে এখন তেমন কোনো খারাপ অবস্থা তৈরি হয়নি। জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, তারা বিভিন্ন এলাকায় চাল, গম ও শুকনো খাবার বিতরণ করছেন।

দুর্গত মানুষের জন্য সরকার সবকিছু করবে। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ১২ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পানি কমছে ধীরগতিতে। তবে আশা করি দু-এক দিনের মধ্যে কমে যাবে।

কুড়িগ্রাম : কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলাসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি ঢুকে পড়ছে নদ-নদী তীরবর্তী চরের নিম্নাঞ্চলগুলোতে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের বজড়া বিয়ারখাতা, খেরুয়ারচর, খেদাইমারী, ফেসকার চর, নাইয়ের চর, দুইশোবিঘাসহ প্রায় ২০টি গ্রাম, অষ্টমীরচর ইউনিয়নের মুদাফত কালিকাপুর, ডাটিয়ারচর, নটারকান্দি ও দিঘলকান্দিসহ প্রায় ১৫টি গ্রাম, চিলমারী ইউনিয়নের মানুষমারার চর, আমতলার চর, কড়াই বরিশালসহ প্রায় ১০টি গ্রাম ও সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের তিনহাজারীর চর, ভগবতীর চর, খেয়ার আলগার চর, চর যাত্রাপুর, চরপার্বতীপুরসহ ১২টি গ্রামের প্রায় শতাধিক মানুষ। এ ছাড়াও নতুন জেগে ওঠা চরের ঘর-বাড়িগুলো প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে রৌমারী উপজেলার সাহেবের আলগা বিজিবির বিওপি ক্যাম্প সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের বামতীর রক্ষা প্রকল্পের ৯০ মিটার বাঁধ ধসে গেছে। চিলমারী উপজেলার অষ্টমীর ইউনিয়নের ডাটিয়ার চরের শাহজাহান আলী জানান, বন্যার পানি বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। চিলমারী উপজেলার নয়ারচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু হানিফা জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আমার ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের ঘর-বাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। নদের পানি এভাবে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পুরো ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়বেন।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৩৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া নুন খাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৩২ সেন্টিমিটার, ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার ও তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

 

সর্বশেষ খবর