শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বারবার কেন বয়লার বিস্ফোরণ

মাহবুব মমতাজী

পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানায় বারবার বয়লার বিস্ফোরণ হচ্ছে। গত এক বছরে সারা দেশে এ ধরনের ঘটনায় অন্তত ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সমস্যা সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, কারখানা মালিকদের গাফিলতির কারণে এর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বয়লার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। নতুন করে বসানোর ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা লাগবে এ চিন্তা থেকে পুরনো বয়লার দিয়েই কাজ চালানো হয় কারখানাগুলোতে। যদিও বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব শ্রম মন্ত্রণালয়ের কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের। এ ছাড়া দক্ষ কর্মী, টেকনিশিয়ান এবং যথাযথভাবে পরিচালনা ও সুপারভিশনের অভাবে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে বারবার। শ্রমিক নেতাদের মতে, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও কারখানা মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বারবার বয়লার বিস্ফোরণ হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, সারা দেশে পাঁচ হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কল-কারাখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর যথাযথ আইন প্রয়োগ না করায় শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কল-কারখানায় নিরাপত্তা ত্রুটির কারণে মাঝেমধ্যেই বড় বড় বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে হতাহত হচ্ছেন শত শত শ্রমিক। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর সূত্র জানায়, সর্বশেষ ৩ জুলাই গাজীপুর কাশিমপুরে মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামে পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। এতে আহত হন ৭০ জন। এর আগে গত বছর ২৩ জানুয়ারি গাজীপুরের পুবাইলে স্মার্ট মেটাল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে একই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ছয়জনের। ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টেম্পাকো ফয়েল লিমিটেডে ৩৯ জন কর্মীসহ মোট ৪২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন। চলতি বছর ১৯ এপ্রিল দিনাজপুরে গোপালগঞ্জ যমুনা অটো রাইস মিলে বয়লার বিস্ফোরণে ১৭ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হন। জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস সদরের মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টেশন অফিসার খুরশিদ আনোয়ার এ প্রতিবেদককে বলেন, তদন্তে ঘটনার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসে মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার। বয়লারের মেয়াদ শেষ হলেও মালিকরা গাফিলতির কারণে তা পরিবর্তন করেন না। হয়তো তারা ভাবেন, নতুন বয়লার স্থাপনে টাকা-পয়সা লাগবে। তাই এভাবে যত দিন চলে চলুক। বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক এম দেলোয়ার হোসেন জানান, কারখানা মালিকদের দায়িত্বহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কারখানা পরিচালনার কারণে বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াও দুর্ঘটনা পুনরাবৃত্তির অন্যতম কারণ। বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বয়লার বিস্ফোরণ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের গেল বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওই বছর সারা দেশে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৮৫৮টি। এর মধ্যে ঢাকায় আগুন লাগার ঘটনা ২০টি। এতে ক্ষতি হয়েছে ৬৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। আর সারা দেশের ক্ষতির পরিমাণ ২৪০ কোটি ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ৮২২ টাকা। অগ্নিকাণ্ডে সারা দেশে মৃত্যু হয়েছে ৫২ জনের। আর আহতের সংখ্যা ২৪৭। এদের মধ্যে ঢাকায় আহত হন ৮১ জন আর ১৫ জনের মৃত্যু হয়। শিল্প-কারখানায় এক হাজার ১৬৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে ঢাকায় ঘটেছে ৫৭৮টি। পোশাক কারখানায় আগুনের ঘটনা ছিল ২৫৮টি এবং এর মধ্যে ঢাকায় ১৪২টি। বস্তিতে আগুন লেগেছিল ১৭০টি। এর মধ্যে ঢাকায় ২৭টি। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা এক হাজার ৮৪৫টি। এতে ক্ষতির পরিমাণ ৩৫ কোটি ৮১ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা। পোশাক কারখানায় ঘটেছে ১০টি। এ সংখ্যা বহুতল ভবনে ২৮। এসব ঘটনায় আহত হয়েছে ৪১ জন। আর মৃত্যু হয় ১৪ জনের। জানা গেছে, কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর থেকে বয়লারের অনুমতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সাড়ে পাঁচ হাজার নিবন্ধিত বয়লারের জন্য পরিদর্শক আছেন মাত্র ছয়জন। বয়লারগুলো বছরে একবার পরীক্ষা করতে হলে একেকজন পরিদর্শককে ৩৬৫ দিনে ৯১৬টি বয়লার পরীক্ষা করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে চাতালগুলোতে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ছিল। এখন কারখানায় বয়লার স্থাপন করা হয় বিদেশি টেকনোলজি দিয়ে। সেগুলো দক্ষ কর্মী কিংবা টেকনিশিয়ান দিয়ে যথাযথভাবে পরিচালনা ও সুপারভিশন করা হয় না। এ কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ খবর