শনিবার, ৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

কমিশন ব্যবসা করছে ব্যাংকগুলো

শিল্পায়ন-বিনিয়োগ গুরুত্ব নেই

আলী রিয়াজ

দেশের শিল্পায়ন বিনিয়োগে গুরুত্ব না দিয়ে কমিশন ব্যবসা করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই এখন মূল ব্যবসা কমিশন। আমদানি-রপ্তানির কমিশন, বিভিন্ন ধরনের কার্ডের কমিশন, ব্যাংকিং সিকিউরিটি কমিশন, বৈদেশিক ঋণের কমিশন, রেমিট্যান্স কমিশন, সাবসিডিয়ারি কোম্পানির কমিশন থেকেই আসে ব্যাংকের সিংহভাগ মুনাফা। ব্যাংকিং পরিভাষায় নন-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবছর। বর্তমানে দেশের সব ব্যাংকের বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার প্রায় ৪০ শতাংশই নন-ব্যাংকিং মুনাফা থেকে অর্জিত হয়। কোর ব্যাংকিং হিসেবে পরিচিত ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোর অনীহা দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোর ব্যাংকিংয়ে গুরুত্ব না দিয়ে সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে নন-ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এটা কমানো উচিত। নইলে দেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে ৫৬টি ব্যাংকের মোট মুনাফার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের সব ব্যাংকের মোট মুনাফার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ মুনাফাকারী ব্যাংক হিসেবে রয়েছে— ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক ৩২০ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৩৬০ কোটি, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক ২৪৩ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৩৫০ কোটি, পূবালী ব্যাংক ৪৬০ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩২৫ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৪০৮ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংক প্রায় ৫০০ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ৩০৭ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৩০১ কোটি, রূপালী ব্যাংক ২৬০ কোটি, সোনালী ব্যাংক ২০৫ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ২০৯ কোটি, যমুনা ব্যাংক ২০০ কোটি, মধুমতি ব্যাংক ৭৩ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ৬৮ কোটি এবং সাউথ বাংলা ব্যাংক ৬৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এ ছাড়া অন্য ব্যাংকগুলোর মুনাফাও বেড়েছে। এই মুনাফার প্রায় ৪০ শতাংশ এসেছে বিভিন্ন ফি বা কমিশন থেকে। ব্যাংকগুলোর সুদ থেকে আয়ের পরিমাণ দিন দিন কমছে। বেশির ভাগ ব্যাংক সুদ আয়ের মধ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বেশি দেখায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো স্থগিত সুদ হিসাবকে আয় হিসাবে দেখায়। এমনকি খেলাপি ঋণকে নিয়মিত ঋণ হিসাবে দেখানো হয়। চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ আয়ে জালিয়াতির করার অভিযোগে একাধিক ব্যাংককে চিঠিও দেয়। ওই চিঠিতে ব্যাংকগুলোকে মুনাফার সঠিক তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দেয়। রাষ্ট্রায়ত্তসহ বেসরকারি একাধিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকগুলোর মুনাফার বড় অংশ আসে বৈদেশিক বাণিজ্য, কার্ড বিক্রি ও কমিশন, গ্যারান্টি ফি থেকে। প্রতিবছর দেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার, রেমিট্যান্স আসে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এর পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে হয়। এই বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা কমিশন পায় ব্যাংকগুলো। এর বাইরে নতুন কয়েকটি ব্যাংক বাদে সব প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে। সেসব কোম্পানির মাধ্যমে মুনাফার একটি বড় অংশ আসে। গত কয়েক বছরে ক্রেডিট কার্ড বিক্রি ও এটিএম বা অনলাইন লেনদেনের কমিশন ব্যাংকের মুনাফার একটি বড় অংশ। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের এখন মূল ব্যবসা অফসোর ব্যাংকিং। অর্থাৎ বিদেশি ঋণ দেশীয় উদ্যোক্তাদের এনে দেওয়া ও গ্যারান্টার হওয়া। এই অফসোর ব্যাংকিং থেকেই ওই ব্যাংকগুলো মুনাফা করছে। স্থানীয় বিভিন্ন ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো গ্যারান্টি কমিশন ব্যবসা করে থাকে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ফিস মুনাফা ব্যাংকের জন্য নিরাপদ। এ জন্য এটা সবাই করছে। এটা বৃদ্ধি পেলে দেশের বা অর্থনীতির জন্য ভালো হতে পারে। কিন্তু শুধু এই বাণিজ্য যদি করে অর্থাৎ কোর ব্যাংকিং বাদ দেওয়া উচিত নয়। বেসরকারি মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, কোর ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকি রয়েছে। নন-ব্যাংকিং মুনাফার ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি নেই। দেশের ব্যাংকিং মুনাফার বড় অংশই এখন নন-ব্যাংক মুনাফা। অনেক ব্যাংকের নন-ব্যাংক মুনাফার পরিমাণ কোর ব্যাংকিংয়ের চেয়ে বেশি।  এটা মন্দ নয়। তবে শিল্পায়ন বা বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কী হচ্ছে সেটা দেখা উচিত।

সর্বশেষ খবর