মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
বন্যা পরিস্থিতি

৭ জেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী

প্রতিদিন ডেস্ক

৭ জেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী

টানা বর্ষণে অবনতি হয়েছে জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি। পানির নিচে ডুবে আছে দেওয়ানগঞ্জ ইসলামপুর মেলান্দহ মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ি এলাকার স্কুল-কলেজসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের উত্তরাঞ্চলের সাত জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলে নতুন নতুন এলাকা ডুবে গেছে। লাখ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী।

অন্যদিকে পানি কমায় সিলেট ও মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর— লালমনিরহাট : ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। জানা গেছে, বন্যার পানিপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারেজ এলাকা, হাতীবান্ধার তিস্তা নদীবেষ্টিত কয়েকটি ইউনিয়ন, কালীগঞ্জের ভোটমারী, কাকিনা ইউপি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, মোগলহাট, কুলাঘাট, রাজপুর এলাকার তিস্তা ও ধরলাবেষ্টিত চরের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। গতকাল সকাল ৯টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার বিকাল ৪টায় তা বেড়ে গিয়ে ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ডালিয়া ব্যারাজের সবকটি গেট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। এদিকে ধরলার প্রবল স্রোতে কুলাঘাট ইউনিয়নের শিবেরকুটি এলাকায় অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩০০ মিটার বাঁধ ধসে গেছে। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা ধরলার ৬৩ চরের অধিবাসীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কুলাঘাট ইউপি চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী জানান, দেড় মাস আগে পাউবো কর্তৃপক্ষ জিও ব্যাগ আনলেও তারা ভাঙনকবলিত এলাকায় সেগুলো অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখে। কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেই ৩০০ মিটার এ বাঁধটি ধসে গেল। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বাঁধ ধসে যাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, বাঁধটি রক্ষার জন্য এখন জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

নীলফামারী : উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে নীলফামারীতে তিস্তা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, রবিবার রাত থেকে নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। গতকাল সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও পরে ২ সেন্টিমিটার বেড়ে ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নদী তীরবর্তী ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ওই সব গ্রামে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত ২০ হাজার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, ভারি বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলের কারণে তিস্তার পানি সকাল থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম : ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ সবকটি নদ-নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত হয়েছে উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের ২ শতাধিক গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন এসব এলাকার প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। বন্যাকবলিত বেশির ভাগ মানুষ ৪ দিন ধরে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে ভুগছেন। নিম্নাঞ্চলের পথ-ঘাট ও ঘরবাড়ি তলিয়ে থাকায় দুর্ভোগ বেড়েছে। বন্ধ রয়েছে জেলার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান। এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোনো ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি। সিভিল সার্জন ডা. এস এম আমিনুল ইসলাম জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে ৮৮টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। তারা বন্যার্ত মানুষের জন্য কাজ করছেন। ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) : উজানের পানি ও পাহাড়ি ঢলে ফুলবাড়ীতে ধরলার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ধরলা তীরবর্তী গ্রামসহ চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বিকালে জানিয়েছে, ধরলার পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল দুপুরে সরেজমিন নির্মাণাধীন দ্বিতীয় ধরলা সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের কাদা মিশ্রিত পানি আসছে। এ পানি  ধরলার তীরবর্তী গ্রামগুলোতে হু হু করে প্রবেশ করছে। এভাবে পানি প্রবেশ করতে থাকলে ২৪ ঘণ্টার ভিতর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। এরই মধ্যে সোনাইকাজী, শিমুলবাড়ী যতীন্দ্র নারায়ণ, চর শিমুলবাড়ী, পূর্ব ও পশ্চিম ধনিরাম, চর গোরকমণ্ডল, চর বড়লই, খোঁচাবাড়ি ও রাঙামাটি এলাকায় পানি প্রবেশ করে অন্তত ৫০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ায় সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলায় প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। ফুলছড়ি উপজেলার ৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধসহ চরাঞ্চলবেষ্টিত ৪৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়া নদীভাঙনে ফুলছড়ির এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের ১৩০টি পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে জিগাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জিগাবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়, এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ ও জিগাবাড়ি কমিউনিটি ক্লিনিক। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দীরা এখনো কোনো সরকারি ত্রাণসামগ্রী পাননি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর ও ঘাঘটের পানি বিপদসীমার এক সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া তিস্তা, যমুনা ও করতোয়ার পানি এখনো বিপদসীমার নিচে রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে পানিবন্দী মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভোগ। বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। কাজীপুরের বৃহত্তম ঢেকুরিয়া হাটে পানি ওঠায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় ছাত্রছাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এদিকে এক সপ্তাহ ধরে যমুনার পানি বৃদ্ধি পেলেও রবিবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকার পর আবারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় ৪ সহস াধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। কাজীপুরের ঢেকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা আলেয়া খাতুন জানান, বসতবাড়ি পানির মধ্যে তলিয়ে গেছে। টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় পানি খেতে কষ্ট হচ্ছে। পানিবন্দী ইনসাফ আলী জানান, কর্ম না থাকায় খুব কষ্টে আছি। সরকারিভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা পেলে খুবই উপকার হতো। ঢেকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা খাতুন জানায়, স্কুলে পানি ওঠায় বই-খাতা নিয়ে যাতায়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ছাত্রী রুমা জানায়, স্কুলে পানি ওঠায় অন্য স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ঢেকুরিয়া হাটের ব্যবসায়ীরা জানান, পুরো বাজার পানিতে তলিয়ে গেছে। সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। বেচাকেনায় ধস নেমেছে। জামালপুর : জামালপুরে রবিবার যমুনার পানি ২ সেন্টিমিটার কমলেও গতকাল ২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে উজান থেকে নেমে আসা পানি ছড়িয়ে পড়ছে ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ ভাটির শাখা নদীতীরের জনপদে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে জামালপুর সদরের ৩টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। বন্যার পানি ওঠায় ১০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে জেলার ৬টি উপজেলার ২৩টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। এ ছাড়া অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু সড়ক বাঁধে। টাঙ্গাইল : ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে যমুনা নদীর পানি। গতকাল বিকালে টাঙ্গাইলের নলিন পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে করে জেলার কালিহাতী উপজেলার একটি ইউনিয়ন, ভূঞাপুর উপজেলার তিন ইউনিয়ন ও গোপালপুর উপজেলার একটি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কয়েক দিন ধরে যমুনা নদীর পানি বেড়ে চলছে। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বিকালে টাঙ্গাইলের নলিন পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

মৌলভীবাজার : হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়া জুড়ী ও বড়লেখায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। বাড়ি  ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠা পরিবারগুলো বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন, কিন্তু অনেকের কাঁচা বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন। অন্যদিকে গত ১ জুলাই থেকে হাওরাঞ্চলে ওএমএস বন্ধ থাকায় কষ্ট বেড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের। সরেজমিন হাকালুকি হাওর পাড়ে দেখা গেছে, বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, ধীরে ধীরে পানি কমছে।

সর্বশেষ খবর