বুধবার, ১২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসী মানুষের

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

প্রতিদিন ডেস্ক

দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসী মানুষের

পানি বৃদ্ধির সঙ্গে ভাঙন বেড়েছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলায়। গতকাল কুমারভোগ ইউনিয়নের শিমুলিয়া বাজার থেকে তোলা ছবি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বর্ষাকালের মধ্যবর্তী এ সময়ে দেশজুড়ে প্রচণ্ড দাপট দেখাচ্ছে বৃষ্টি। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলের কারণে দেশের নদ-নদীগুলোর পানি বেড়েই চলেছে। গতকাল ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তাসহ দেশের কয়েকটি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কুড়িগ্রামে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বগুড়ার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। একদিন স্থিতিশীল থাকার পর জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি আবারও অবনতি হয়েছে। পানি বন্দী হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। পানি বিপদসীমার ওপরে থাকায় দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসী মানুষের।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর— কুড়িগ্রাম : সবগুলো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ৫৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়েছে তিস্তা ও দুধকুমারসহ অন্যান্য নদীর পানি। বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের চর ও দ্বীপচরসহ প্রায় আড়াই শতাধিক গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব এলাকার প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ। বানভাসী মানুষজন ঘর-বাড়ি ছেড়ে বাঁধ ও উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। অনেক পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিলেও তাদের হাতে কোনো কাজ না থাকায় অতিকষ্টে দিন যাপন করছেন। বন্ধ রয়েছে জেলার দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ারচর গ্রামের শেফালী বেগম জানান, চার দিন হয় বাড়িতে পানি উঠছে। দুইটা বাচ্চা নিয়া সারাদিন মানুষের নৌকায় নৌকায় ঘুরছি। সারাদিন রান্নাও হয় নাই, খাইও নাই। মেম্বার চেয়ারম্যান কোনো রিলিফ দেয় নাই। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, আমার ইউনিয়নের চরাঞ্চলগুলোর ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে ১৫০ জনকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, বন্যার পানিতে ৭৭১ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। বগুড়া : সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার নতুন নতুন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলার কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা, চালুয়াবাড়ী, কাজলা, কর্ণিবাড়ী, বোহাইল, হাটশেরপুর ও সারিয়াকান্দি এ ৯টি ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামের ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা শাহারুল ইসলাম মো. আবু হেনা জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ ইউনিয়নের ৭৫ গ্রামের ১৩ হাজার ২২২ পরিবার। সারিয়াকান্দি আশ্রয়প্রকল্পে আশ্রয় নিয়েছে ৭৬৫ পরিবার। জেলা শিক্ষা অফিসার গোপাল চন্দ্র জানান, বন্যায় পানি প্রবেশ করায় ৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র জানান, পাট, ধান, সবজি ও বীজতলাসহ ৩ হাজার ৮৭৭ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে ক্ষতি হয়েছে। নীলফামারী : গতকাল বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তার পানি। সকাল ৬টা থেকে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে। উজানের ঢল আর ভারি বর্ষণের কারণে তিস্তা নদী বেষ্টিত ১০টি ইউনিয়ন এবং ২০টি চরে দেখা দিয়েছে বন্যা। খাদ্যাভাব এবং নানা সংকটে পড়েছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, তিস্তা নদীর ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের সবকটি কপাট খুলে দেওয়ায় পানি বেড়েছে তিস্তা ব্যারেজের নীলফামারী পয়েন্টে। পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান জানান, অধিকাংশ এলাকায় পানি প্রবেশ করায় ঘর-বাড়ি হাঁটু পানিতে তলিয়ে রয়েছে। গতকাল থেকে রান্না করতে না পারায় খাদ্যাভাবে পড়েছেন ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার মানুষ। দ্রুত শুকনো খাবার বিতরণ করা প্রয়োজন। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী, ঝুনাগাছ চাপানি, খালিশা চাপানি, পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, গয়াবাড়ী এবং জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, শৌলমারী, কৈমারী ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন। পানি বৃদ্ধির ফলে হুমকির মুখে পড়েছে টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ী গ্রামের স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বালু বাঁধটি। যে কোনো মুহূর্তে ধসে গেলে পানিতে তলিয়ে যাবে চারটি ওয়ার্ড। জামালপুর : বন্যা পরিস্থিতি আবারও অবনতি হয়েছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, গতকাল বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বেড়ে বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যমুনার সঙ্গে বাড়ছে ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ শাখা নদীগুলোর পানি। বন্যায় জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ী, মাদারগঞ্জ ও জামালপুর সদরের ২৫টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ডাউভারশানে পানি উঠায় ব্যাহত হচ্ছে মেলান্দহ-মাহমুদপুর সড়ক যোগাযোগ। বন্যা দুর্গত এলাকায় খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব তীব্র হয়ে উঠেছে। মিলছে না গো-খাদ্যও। লালমনিরহাট : ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি গতকাল সকাল থেকে আবারও বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তিস্তা ও ধরলা নদীর ৬৩ চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ধরলার পানির শ্রোতে সদরের কুলাঘাট ইউপির শিবেরকুটি এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বাঁধটি ধসে গেছে, তিস্তার প্রবল পানির সে াতে ভেসে গেছে হাতীবান্ধার ধুবনি এলাকার বালুর বাঁধ। ফলে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কুলাঘাট ইউনিয়নের শিবেরকুটি এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত ৩০০ মিটার বাঁধ ধসে গেছে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলার তীব্র পানির স্রোতে অর্ধ শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে, তিস্তার পানির গতিতে ভেসে গেছে হাতিবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারিতে অবস্থিত ধুবনি বালুর বাঁধটি। গড্ডিমারি ইউপি চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেই এ বাঁধ ভেসে গেছে। তিস্তা ধরলার পানির সে াতে চরের অনেক রাস্তাঘাট ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বিপদসীমার ৫২ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগও বাড়ছে। অনেকে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। পানিবন্দী মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যা কবলিতদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সংকট। সরকার থেকে যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে তা অপ্রতুল। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে কাজিপুরের মাছুয়াকান্দি, ক্ষুদবান্ধি, শুভগাছা, সদরের বাহুকা ও ভাটিতে এনায়েতপুর বামগ্রামন ও শাহজাদপুরের কৈজুরী ইউপির হাটপাঁচিল এলাকায় তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনে সহস াধিক বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব এলাকায় এখন পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়া এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। অন্যদিকে, পানি বৃদ্ধির কারণে সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, চৌহালী বেলকুচি ও শাহজাদপুরের কয়েক সহস াধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী এলাকায় শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো অনেকস্থানে তা পৌঁছেনি। পানিতে চলাফেরা করায় অনেকের হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। ইউপি সদস্য আবদুল লতিফ জানান, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রায় ৫ শতাধিক বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা পাউবো খোঁজ নিতেও আসেনি। কাজিপুরের ঢেকুরিয়া গ্রামের স্কুল ছাত্র নয়ন জানান, পচা পানিতে হাতে ঘা দেখা দিয়েছে। সারাক্ষণ শুধু চুলকায়। জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকা জানান, ৬৪ মে. টন চাল ও নগদ ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। যা বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

এ ছাড়াও জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপজেলাওয়ারী দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম পেইঞ্জ জানান, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সোমবার আরও অবনতি হওয়ায় সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাাবিত হয়েছে। চার উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এদিকে পানির তোড়ে গাইবান্ধার সদর উপজেলার কামারজানি বন্দরের দক্ষিণ দিকে ভাঙন শুরু হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর