বুধবার, ১২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
কুয়াকাটার সমস্যা ও সম্ভাবনা ১

মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নেই হতাশা

সঞ্জয় কুমার দাস, পটুয়াখালী

মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নেই হতাশা

সূর্যোদয়ের কুয়াকাটাকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারিভাবে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে এতে স্থানীয়দের মাঝে বড় আশার সঞ্চার হয়। বিনিয়োগ নিয়ে ছুটে আসে বিভিন্ন মহল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেমন কিছু করা হয়নি। ফলে অপেক্ষার পর অপেক্ষা করে উদ্যোক্তা এবং আগ্রহীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্যানুযায়ী, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের লীলাভূমি সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাকে ১৯৯৮ সালের মে মাসে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করার পর থেকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় পর্যায় ও দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখানে বিনিয়োগ শুরু করেন। তারা জমিজমা ক্রয় ও বিক্রয়সহ হোটেল-মোটেল স্থাপনা নির্মাণের কাজ হাতে নেন। পর্যটকদের সেবার মান বাড়াতে বর্তমান সরকার ২০১০ সালে উন্নয়নের স্বার্থে কুয়াকাটাকে পৌরসভা ঘোষণা করে। এরপর ২০ বছর মেয়াদি কুয়াকাটার টেকসই ও কার্যকর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। এ লক্ষ্যে ২০১১ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কুয়াকাটা পর্যটন এলাকার জন্য মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত জমি ক্রয় ও বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে বিপাকে পড়ে যায় জমির ওপর আয়-নির্ভর স্থানীয় মানুষ, ব্যবসায়ী ও ডেভেলপার কোম্পানিসহ বহু প্রতিষ্ঠান। শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করেন। যে কারণে কুয়াকাটায় নতুন করে আর কোনো স্থাপনা গড়ে উঠছে না। হচ্ছে না উন্নয়ন। পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা জানান, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের নামে বছরের পর বছর কুয়াকাটার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। জমি বিক্রির জন্য অনুমোদন নিতে আবেদন করে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। আর সংশ্লিষ্ট দফতরের ফাইল পাস করতে অনৈতিক সুবিধা দিতে হয়। তারপরও জমি বিক্রির অনুমতি নিতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস। বিপদ-আপদ, রোগবালাই, ছেলেমেয়ের পড়াশোনাসহ বিবাহ অনুষ্ঠানের খরচের জন্য সমস্যায় পড়ে বাপ-দাদার রেকর্ডীয় সম্পত্তি বিক্রি করতে চাইলেও দীর্ঘ সময় লেগে যায় এবং অনুমতির আবেদন করে ঘুষ দিতে হয়। কুয়াকাটার রিয়েল এস্টেট কোম্পানি সেঞ্চুরির সার্ভেয়ার ও স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল কুদ্দুস জানান, কুয়াকাটার উন্নয়নে সরকারের হাতে নেওয়া মাস্টারপ্ল্যান করায় আমরা আনন্দিত। গেজেট অনুযায়ী মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় যে যে জমি প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করে সীমানা দিয়ে বাকি জমি অবাধে বেচা-বিক্রির ব্যবস্থা করা উচিত প্রশাসনের। কিন্তু জমি-জমা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। তাই কুয়াকাটার সব ব্যবসায় মন্দা ভাব দেখা দিয়েছে। একটা জমি বিক্রি করতে অনুমতির জন্য প্রথমে যেতে হয় ভূমি অফিসে, তারপর কলাপাড়া। এরপর পটুয়াখালী হয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে। আবার ওই আবেদন পটুয়াখালী হয়ে কলাপাড়া আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তাই বড় বড় কোম্পানির জমি কেনাবেচা একেবারেই বন্ধ থাকার কারণে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানি সেঞ্চুরির কুয়াকাটার ম্যানেজার শফিকুল আলম চৌধুরী জানান, দীর্ঘ বছর ধরে কুয়াকাটা জমি-জমা ক্রয়-বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে জমি-জমা বিক্রি করতে সময় লেগে যায়। তাই কোম্পানির কাছ থেকে জমি ক্রেতারা দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে আর বিক্রেতারাও ধরনা দিচ্ছে। তারা মনে করছে কোম্পানিরা মনে হয় ইচ্ছা করে এভাবে বিলম্ব করছে। আসলে তা নয়। এ জন্য ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

কুয়াকাটার বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান বলেন, সরকার কর্তৃক কুয়াকাটার উন্নয়নে যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো তা দ্রুত বাস্তবায়ন না করলে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা তার চিরচেনা ঐতিহ্য হারাবে। আর কুয়াকাটার ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা ভাবে উন্নয়ন ব্যাহত এলাকায় সব ধরনের সুবিধা না পেয়ে পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না, তাই পর্যটকরা তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, পর্যটন মৌসুমে হোটেল-মোটেল সংকটে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় পর্যটকদের। তাই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে এ সংকট দ্রুত সমাধান করা উচিত। কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল বারেক মোল্লা জানান, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কুয়াকাটার মহাপরিকল্পনা প্রজ্ঞাপন জারি করে শুধু বই আর সিট কাগজে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কোনো উন্নয়ন তো দেখছি না। মাস্টারপ্ল্যান আলোর মুখ না দেখায় এখানের উন্নয়ন ও ব্যবসা বাণিজ্যের মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই কুয়াকাটা হারাচ্ছে তার পর্যটন ঐতিহ্যকে। তাই অবিলম্বে মহাপরিকল্পনার আওতায় যেসব জমি প্রয়োজন ওই সব জমির সীমানা নির্ধারণ করে অবাধে কুয়াকাটা-লতাচাপলিসহ ৪টি মৌজার জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে- তার ব্যবস্থা করা উচিত। কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম সাদিকুর রহমান বলেন, ২০১৩ সালের জুন মাসে কুয়াকাটার মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শেষ করে গেজেটের পর বই আকারে প্রকাশ করে গৃহায়ণ, গণপূর্ত ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। পটুয়াখালীর মহিপুর থানার কুয়াকাটা ও এর পার্শ্ববর্তী ধূলাসার ইউনিয়নের চরকাউয়া, গঙ্গামতি, লতাচাপলি ইউনিয়নের সবকটি মৌজার মোট ১০ হাজার ২৭৯.৫৮ একর এলাকাজুড়ে বাস্তবায়ন করা হবে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা। এ ছাড়াও কুয়াকাটা পৌরসভার সাড়ে ৩ হাজার একর জমিতে পরিকল্পনা মাফিক উন্নয়ন করা হবে। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা ও পর্যটন অঞ্চল বিশেষ আইন-২০১০। মহাপরিকল্পনার কাজ ২০১০-৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। পরিকল্পনা মাফিক স্ট্রাকচারাল প্ল্যান ও আরবান এরিয়া প্ল্যান দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে মাস্টারপ্ল্যানের কার্যক্রম। এর মধ্যে জমির ব্যবহার, পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনা, যাতায়াত ও পয়ঃনিষ্কাশন পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এ চার ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে মাস্টারপ্ল্যান। তার মতে, কুয়াকাটার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রাথমিক কাগজপত্র তৈরি করে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেখানকার জমি ক্রয়-বিক্রয়ে অনুমতি দেওয়া অব্যাহত আছে। নবাগত জেলা প্রশাসক ড. মাছুমুর রহমান বলেন, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিক করা হয়েছে। যেহেতু সরকার কুয়াকাটাকে সাজাতে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাই জমি-জমা অবাধে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী নির্দেশনা পাওয়ার জন্য।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর