শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
শত বছরের ঐতিহ্য বগুড়ার আকবরিয়া হোটেল

অভাবী মানুষের জন্য বিনামূল্যে খাবার

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

অভাবী মানুষের জন্য বিনামূল্যে খাবার

শত বছর ধরে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে চলেছে বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। বগুড়া শহর ও আশপাশের জেলার ভাসমান মানুষ, ভিক্ষুক, গরিব, ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষদের এই বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয়। এ হোটেলে প্রতিদিন রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে শহরে অবস্থানরত নাম-পরিচয়হীন মানুষদের এক বেলা ভালোমানের খাবারের ব্যবস্থা করে হোটেল কর্তৃপক্ষ। অভাবী মানুষদের মাঝে খাবার বিতরণ শুরু করেন মরহুম আকবর আলী মিঞা; যা প্রায় শত বছর ধরে চালু রেখেছে হোটেলটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলহাজ আকবর আলী মিঞা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্যান্বেষণে সপরিবার বাংলাদেশের পাকশী, সান্তাহার এবং পরে বগুড়ায় আসেন। স্বাধীনচেতা আকবর আলী মিঞা ভাইয়ের সঙ্গে মেকানিকের কাজ শুরু করেন। ওই সময় বগুড়া শহরে মুসলমানদের খাবারের কোনো হোটেল ছিল না। হিন্দুদের হোটেলে মুসলমানরা যেতেন না। আবার হিন্দুরা তাদের হোটেলের আসবাবপত্র মুসলমানদের ছুঁতেও দিতেন না। ফলে তার মনে একটি হোটেল করার চিন্তা আসে। ১৯১১ সালে বর্তমান শহরের চকযাদু রোডের মুখে মাসিক ৮ টাকা ভাড়ায় একটি হোটেল শুরু করেন। সেই শুরু। বগুড়া শহরে সে সময় আকবর আলীর ছোট্ট হোটেলই ছিল মুসলমানদের একমাত্র খাবার হোটেল। খুব দ্রুত হোটেলের নামডাক ছড়িয়ে যায়। বগুড়ায় সে সময় মুসলমানের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে খদ্দেরের স্থানসংকুলান হতো না। খদ্দেরের কথা ভেবে তিনি শহরের (বর্তমান) থানা রোডে হোটেলটি স্থানান্তর করেন; যা বর্তমানে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল হিসেবে পরিচিত। ধর্মভীরু আকবর আলী ব্যবসায় উন্নতি ও প্রসারে আল্লাহর রহমত আছে এই বিশ্বাস থেকেই আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতিদিন রাতে গরিব, মুসাফির, ভিক্ষুক, মিসকিনদের খাওয়াতেন; যা তিনি মৃত্যু পর্যন্ত করে গেছেন। ১৯৭৫ সালে তিনি মৃত্যুর আগে তার পুত্রদের হোটেলের আয় থেকে ফকির, মিসকিন, গরিবদের খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে যান। সে কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি আজও। আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের এখন শহরেই চারটি শাখা। কবি নজরুল ইসলাম সড়কে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল, ইয়াকুবিয়ার মোড়ে মিষ্টি মেলা, কোর্ট চত্বরে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট এবং শজিমেক হাসপাতালে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, চার মাথা বাস টার্মিনালে রেস্টুরেন্ট সংযোজন করা হয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার নদী ভাঙনের শিকার হোসেন আলী জানান, একসময় সারিয়াকান্দিতে বাবার পাওয়া জমি চাষ করে তার সংসার চলত। যমুনার গ্রাসে জমিগুলো সব হারিয়ে গেছে। দিনে যা আয় করেন তা দিয়ে দিনে চলে। আর রাত হলে আকবরিয়া হোটেলের খাবার গ্রহণ করেন। বগুড়া স্টেশন রোডের ফুটপাথের ভিক্ষুক মো. আসলাম হোসেন জানান, সারা দিন ভিক্ষা করে যা পান তা দিয়ে তার দিন চলে আর রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে ঘুমান। রোজার সময় তিনি আকবরিয়া হোটেলের খাবার সাহরি হিসেবে খেয়ে রোজা রাখতেন। বগুড়া শহরের বৃদ্ধা করিমন নেছা জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে তাকে আর দেখে না। একটা সময় ঝি-এর কাজ করতে পারতেন এখন আর পারেন না। সারা দিন ভিক্ষা করে রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে স্টেশনের পাশে একটি ছোট্ট ঘরে থাকেন। ৬৫ বছরের রমজান আলী ব্যাপারী জানান, একসময় বগুড়া শহরে দিনমজুরি করতেন। ওই সময় থেকে তিনি আকবরিয়া হোটেলে বিনামূল্যে খাবার দিতে দেখে আসছেন। এখন তিনি আয়-রোজগার করতে পারেন না বলে রাতের বেলা হোটেলের খাবার খেয়ে থাকেন। মরহুম আকবর আলী মিঞার ছোট ছেলে ও আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. হাসান আলী আলাল জানান, ‘এ হোটেলের আয় দিয়ে বাবা প্রথম দিনহীন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাবার সেই নিয়ম পালন করে যাওয়া হচ্ছে। এ খাবার বিতরণের জন্য প্রতিদিন ১ মণেরও বেশি চাল রান্না করা হয়। আলাদাভাবে রান্না করে খাবার বিতরণ করা হয়।’ বগুড়া জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর রামচন্দ্র সাহা বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে জেনেছি, নতুন করে খাবার রান্না করে গরিব মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হয়। তিন-চার শ গরিব মানুষ এ খাবার খেয়ে থেকেন।’

সর্বশেষ খবর