দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও কোথাও কোথাও ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জ সদরের বাহুকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বিকল্প বন্যা নিয়ন্ত্রণ রিং বাঁধ ধসে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি ঢুকেছে। এ ছাড়া গাইবান্ধা, লালমনিরহাটেও ব্যাপক ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাহুকায় দুই পয়েন্টে প্রায় ৫০ মিটার এলাকা ভেঙে যাওয়ায় লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে বাহুকা-পূর্ব বাহুকা-গজারিয়া, চিলগাছা ও ইটালী গ্রামের সহস্রাধিক বসতবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করায় ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। আকস্মিক এ ঘটনায় আসবাবপত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আতঙ্কিত অনেক লোক বাড়িঘর ছেড়ে আসবাবপত্রসহ ওয়াপদা বাঁধ ও স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। জানা গেছে, মাত্র এক মাস আগে বাহুকা থেকে টুটুলের মোড়ের মাঝামাঝিতে সিরাজগঞ্জ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যায়। এ কারণে পানি যাতে লোকালয়ে প্রবেশ না করতে না পারে সেজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড আধা কিলোমিটার পেছনে নতুন মাটির বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। কিন্তু কাজ ধীরগতি হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নতুন বাঁধের বাহুকা পয়েন্টে প্রথমে নতুন-পুরাতন বাঁধের মাঝে লিঙ্ক বাঁধে ২৫ মিটার ভেঙে যায়। তত্ক্ষণাৎ পাউবো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রবল স্রোতে নতুন বাঁধের ২৫ মিটার এলাকায় পানি প্রবেশ শুরু করে। এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বাহুকা-পূর্ব বাহুকা-ইটালী, গজারিয়া গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, ইঁদুরের গর্তের কারণে প্রথমে সামান্য পানি লিক করে। একপর্যায়ে বাঁধটি ভেঙে যায়। পরে নতুন রিং বাঁধটিও ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। রাত ২টা থেকে ভাঙা অংশে সংস্কারকাজ শুরু করা হয়। সকালে সেনাবাহিনীর ১১ পদাতিক ডিভিশনের রিভার কোরের মেজর সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা সংস্কারকাজে অংশ নেন।
অন্যদিকে গতকাল যমুনার পানি ৪ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি কমলেও পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ এখনো কমেনি। জেলার পাঁচ উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের ২৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। আর নদী ভাঙনে ৫ শতাধিক বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দী এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট, ফুলছড়ির কুচখালী, হারোডাঙ্গা, কাবিলপুর এলাকা অব্যাহত ভাঙনে এখন বিপন্ন। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বন্যার পানির স্রোতে কামারজানি ইউনিয়নের কলমু এসএমসি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে চলে যায়। নদী ভাঙনের ফলে কামারজানির গোঘাটে বসবাসরত ৭০টি বাড়িঘরের ভিটেমাটি ভেঙে গেছে। এ ছাড়া বন্যার পানির তীব্র স্রোতের কারণে ফুলছড়ি উপজেলার সিংড়িয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি চরম হুমকির মুখে রয়েছে। এদিকে বন্যাকবলিত চার উপজেলার ৩ লক্ষাধিক মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকট, পয়ঃনিষ্কাশনসহ নানা সমস্যায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সরকারিভাবে যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে চাহিদার তুলনায় তা একেবারে নগণ্য। কোনো রাজনৈতিক দল, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা এনজিওকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে বন্যার পানির কারণে সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ১৪১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুব একটা নেই।লালমনিরহাট : তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি কমতে শুরু করলেও ক্রমে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। খাদ্য, গো-খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ না থাকায় অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটছে পানিবন্দী মানুষের। চরাঞ্চলের অনেক স্থানে এখনো পৌঁছেনি ত্রাণ। ফলে হাহাকার চলছে মানুষের মধ্যে। দুর্গত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। এদিকে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা-ধরলা পাড়ে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েক দিনে নদীগর্ভে গেছে শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি, কয়েক শ বিঘা ফসলি জমি। আদিতমারী উপজেলার তিস্তাসংলগ্ন গোবর্ধন এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ ভাঙন শুরু হলে অল্প সময়ের মধ্যে ২৭টি পরিবারের বাড়িঘর তিস্তায় বিলীন হয়ে যায়। অন্যদিকে সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের চার গ্রাম— চওড়াটারী, মোগলহাট, মাছুয়াটারী ও কর্ণপুরে ধরলার ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত এক সপ্তাহে বসতভিটা হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে অর্ধশতাধিক পরিবার। নদীগর্ভে চলে গেছে শত শত বিঘা আবাদি জমি, কয়েকটি ফলের বাগান ও বাঁশঝাড়। এ ছাড়া পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জেলার পাঁচ উপজেলার তিস্তা পাড়ের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। বগুড়া : বগুড়ার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি স্থিতাবস্থায় রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বৃদ্ধি না পেলেও বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বগুড়া জেলা প্রশাসক নূরে আলম সিদ্দিকী গতকাল বিকালে তার সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানান, বন্যায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের মোট ১৪ ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের ১৭ হাজার ৪০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা ও ১টি কলেজ বন্যাকবলিত হয়েছে। পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ৫ হাজার ৮৫ হেক্টর জমির ফসল। এতে প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ১০০ পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় কয়েক লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। প্রায় ৪০০ মেট্রিক টন খড় ও ৪৬০ মেট্রিক টন ঘাস বিনষ্ট হওয়ায় গবাদিপশুর খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ৬০ কিলোমিটার কাঁচা ও ৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফরিদপুর : ফরিদপুরে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল ১২ ঘণ্টায় পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধির ফলে ফরিদপুরে পদ্মা-তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল, ডিক্রির চর এবং চরভদ্রাসন উপজেলার গাজীরটেক, চরহরিরামপুর, ঝাউকান্দা ইউনিয়নের বেশির ভাগ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান মোস্তাক জানান, দ্রুত গতিতে পানি বাড়ার কারণে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে কয়েক দিনের মধ্যে নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের বেশির ভাগ বাড়িতে পানি ঢুকে পড়বে। ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, কয়েক দিন ধরে পদ্মার পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই ১০-১৫ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। তিনি জানান, জেলার সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর ও আলফাডাঙ্গা উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ শুরু করেছে।
জামালপুর : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া গতকাল বিকালে জামালপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বিশেষ সভায় বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কষ্ট দূর না হওয়া পর্যন্ত বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে কেউ টালবাহনা বা দুর্নীতির আশ্রয় নিলে তাকে ক্ষমা করা হবে না। দেশের একটি মানুষও না খেয়ে ও গৃহহীন থাকবে না। তিনি বলেন, বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে। তারা যাতে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সরকার সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভাসহ সাত ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ তানভীর আহম্মেদ জানান, বন্যায় ৭৪ হেক্টর আউশ, ৭৪ হেক্টর সবজি, ৩৫০ হেক্টর পাট ও ১৫ হেক্টর বীজতলা ডুবে গেছে। শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কৃষক গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।