সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ত্রাণের অপেক্ষায় দুর্গত মানুষ

পদ্মা এখনো বিধ্বংসী

প্রতিদিন ডেস্ক

ত্রাণের অপেক্ষায় দুর্গত মানুষ

কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। তবে বাড়ছে দুর্ভোগ। মিলছে না খাবার। ত্রাণের অপেক্ষায় জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি ইউনিয়নের দুর্গম চরের মানুষ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে চলেছে। যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ উত্তরাঞ্চলীয় নদ-নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। ফলে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া দুর্গত মানুষ বিধ্বস্ত বসতবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। অন্যদিকে পদ্মা নদীর পানি এখনো বাড়ছে। পাশাপাশি বেড়েছে ভাঙনের তীব্রতা। খাবার সঙ্কটে দুর্ভোগে পড়েছে এসব এলাকার মানুষ। ত্রাণের অপেক্ষায় দিনভর চলছে তাদের অপেক্ষা। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ—

লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি নামতে শুরু করায় জেলার বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন এখন ক্ষতিগ্রস্ত বসতিতে ফিরতে শুরু করেছে। তবে তাদের মধ্যে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষের মাঝে যে সামান্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য বলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানিয়েছে। দুর্গত এলাকার মানুষজন তাদের শিশু, বৃদ্ধ ও পরিবার-পরিজন এবং গৃহপালিত পশু নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে। দুর্গত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। গতকাল যমুনা নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার কমেছে বলে জানিয়েছেন টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ। এদিকে এখনো টাঙ্গাইলের গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, নাগরপুর ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, যমুনা নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় ১৫ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত না হলেও বন্যাকবলিতরা দুর্ভোগে রয়েছে। এখনো বিভিন্ন এলাকায় কোমর পানি থাকায় বানভাসিরা বাড়িঘরে ফিরতে পারছে না। যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে বানভাসিরা আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা সবচেয়ে বেশি ভুগছে খাবার পানি সংকটে। গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি গতকাল আরও কমে যাওয়ায় গাইবান্ধার চারটি উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র-যুমনার পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি গাইবান্ধা পয়েন্টে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে গত দুই দিনে সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের পালিতবাড়ী, কুমারপাড়া ও কালুরপাড়া গ্রামের শতাধিক পরিবার যমুনাগর্ভে ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। সর্বহারা এই পরিবারগুলো সড়ক, বাঁধসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গো-ঘাট এলাকার ভাঙন এখনো প্রতিরোধ করা যায়নি। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, গো-ঘাট এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ফেলার কাজ করছে। কিন্তু কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না ভাঙন। তাই স্থায়ী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা হবে। তিনি আরও জানান, চরাঞ্চলের ভাঙন ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে গতকাল গাইবান্ধার বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করতে এসে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী বীর বিক্রম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এ সময় তিনি জানান, দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি এবং বন্যার্তদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে। তিনি বলেন, সামনে হয়তো আরও বড় ধরনের বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত ও চীনে ব্যাপক বন্যা হয়েছে। ওই পানি এদিকেই আসবে। যার কারণে আমাদেরকে আগাম প্রস্তুত থাকা দরকার। আমাদের সবকিছু প্রস্তুত রাখতে হবে। মাদারীপুর : মাদারীপুর অংশে অস্বাভাবিক গতিতে পদ্মার পানি বাড়ছে। এতে জেলার শিবচর উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের চারটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানির তোড় ও তীব্র স্রোতের ফলে চরাঞ্চলের কাঁঠালবাড়ি ও চরজানাজাত ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদসহ কয়েক হাজার পরিবার। মুন্সীগঞ্জ : পদ্মার তীব্র স্রোত ও ঘূর্ণাবর্তের কারণে গতকাল মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও টংগীবাড়ি উপজেলার নদী তীরবর্তী ২০টি বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে শতাধিক বাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, গতকাল টংগীবাড়ি উপজেলার কামারখাড়া ইউনিয়নের বড়াইল, চৌসার, বাগবাড়ী, জুসিষার গ্রামের ১০টি বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। বড়াইল গ্রামের মসজিদটি সন্ধ্যায় ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামের মাসুম মোল্লা জানান, নিজেদের পাঁচটি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সাত শতাধিক মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছে। কিছু দিন ধরেই নদীর পানি বাড়ছে। ধানখেতসহ ফসলের জমিতে পানি ঢুকেছে। নিম্নাঞ্চলগুলোতে পানি প্রবেশ করায় বিপাকে পড়েছে গ্রামের হাজার হাজার মানুষ।  সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি কমে বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমলেও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। জেলার পাঁচটি উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নের প্রায় ৪৮ হাজার পরিবারের তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে সেখানেও করুণ অবস্থা। টিনের চালা বা পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে ছাগল-গরু-হাঁস-মুরগি ও কুকুরের সঙ্গে একঘরে রাত কাটাতে হচ্ছে তাদের। বাঁধে টিউবওয়েল না থাকায় পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় সবাই বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে নারীরা পড়েছেন মহাবিপদে। রান্না করার খড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ঠিকমতো রান্নাও করতে পারছেন না। কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে বন্যার পানি কমে বিপদসীমার নিচে রয়েছে। পাউবো সূত্র জানায়, ২৪ ঘণ্টায় ধরলা সেতু পয়েন্টে ২৫ দশমিক ৯৮ সেন্টমিটার, তিস্তা কাউনিয়া পয়েন্টে ২৮ দশমিক ৬৩, ব্রহ্মপুত্র নুনখাওয়া পয়েন্টে ২৬ দশমিক ৪৩ ও ব্রহ্মপুত্র চিলমারী পয়েন্টে ২৩ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটারে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি কমলেও বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানিতে চরাঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট দীর্ঘদিন তলিয়ে থাকায় দুর্ভোগ বেড়েছে। সিলেট : ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে সিলেটের ৮ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতিরও কিছুটা অবনতি হয়েছে। এসব উপজেলার কয়েকটি নতুন এলাকাও প্লাবিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, গতকাল বিকাল পর্যন্ত সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার, আলমসিদ পয়েন্টে ১৩৩ সেন্টিমিটার ও শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর