সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মতিহার

মর্তুজা নুর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মতিহার

রাজশাহী শহর থেকে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক পথে ধরে ৮ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এলেই চোখে পড়বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। ভিতরে দেখা মিলবে দেবদারু ও তারিপাম্প গাছের রূপের জাদু আর শোনা যাবে পাতার শনশন শব্দ। বাতাসে ভেসে আসবে ফুলের গন্ধ আর পাখির গুঞ্জন। সামনে যতই এগোনো যাবে— ততই মনে হবে, এ যেন স্বর্গের কোনো লীলাভূমি। 

প্রধান ফটকের পথ ধরে হাঁটার পর মিলবে বৃক্ষশোভিত গোল চত্বর। যার চারদিকটা নির্মিত কংক্রিট আর টাইলসে। শোভা পাচ্ছে হরেক রকমের ফুল। ফুলের মনমাতানো গন্ধ আকৃষ্ট করবে যে কাউকে। রাতে এখানে জ্বলে ওঠে নানান রঙের ঝাড়বাতির আলোর ঝলকানি। এখানেই রয়েছে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে নিহত দেশের প্রথম শহীদ ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিফলক। সামনেই মাথা উঁচু করে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবন। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি গর্বের সঙ্গে অতিক্রম করছে ৬৪ বছর। মতিহারের সবুজ চত্বর নামে পরিচিত এই বিশ্ববিদ্যালয় তার সৌন্দর্য কোটি-কোটি মানুষের প্রাণে স্থান করে নিয়েছে। ভ্রমণ পিপাসু আর বিদ্যানুরাগীদের প্রাণের ক্যাম্পাস এই মতিহারের সবুজ চত্বর। তবে মতিহারের সবুজ গালিচা দেখার জন্য চোখ রাখতে হবে প্রশাসন ভবন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে।

সেখানে দেখা মিলবে একটি রাস্তা, যার দুই পাশে চোখ ধাঁধানো গগন শিরীষ গাছ। পিচঢালা রাস্তার দুই পাশে অতন্ত্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা কচি ডালে সজ্জিত আকাশচুম্বী গাছগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে হবে ফ্রান্সের কোনো এক রাস্তা দিয়ে হাঁটা হচ্ছে। তবে এটি প্যারিসের কোনো রাস্তা নয়, এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট থেকে শেরেবাংলা হল পর্যন্ত চলে গেছে রাস্তাটি। এটি আকৃষ্ট করে প্রকৃতিপ্রেমী হাজারো মানুষকে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা— এমনকি রাতের বেলায়ও এখানে থাকেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষ। তাদের পদচারণা আর গল্প আড্ডা চলে দীর্ঘ সময় ধরে।

শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই নয়, বাইরের দর্শনার্থীদেরও রাস্তাটি হয়ে উঠেছে একটি প্রাণের জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত গ্রাজুয়েশন শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন লাখ লাখ শিক্ষার্থী। প্রকৃতির অপার নিয়মে তারা আজ অনেকেই বৃদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু তারাও ভুলতে পারেন না প্যারিস রোডকে। দিন-মাস-বছর পেরিয়ে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেন প্যারিস রোডের সৌন্দর্যও বেড়েই চলেছে। বাহারি ডালে সজ্জিত কচি পাতার গগন শিরীষ গাছগুলো প্যারিস রোডকে দিয়েছে আলাদা মর্যাদা। প্রকৃতিকে করেছে চির যৌবনা। প্যারিস রোডের পাশেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন। ভবনটির সামনে রয়েছে ফুলের বাগান। চারদিকে গাছপালায় আবৃত ছায়া ও সুশীতল এই ভবনটির পাশেই স্বাধীনতার জ্বলন্ত প্রমাণ শাবাশ বাংলাদেশ ভাস্কর্য। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ভাস্কর্যগুলোর অন্যতম বৃহৎ ভাস্কর্য। এর স্থপতি শিল্পী নিতুন কুণ্ডু। এটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীকী ভাস্কর্য।

শেরেবাংলা ফজলুল হকের সামনে ভাষা আন্দোলন ও গৌরবময় স্বাধীনতার স্মৃতি ধারণ করে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। চার একর জমির ওপর স্থাপত্য কর্মটির মূল স্থাপনার সঙ্গে উন্মুক্ত মঞ্চ, সমৃদ্ধ শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, ক্যাফেটেরিয়া, বাগান ও সবুজ চত্বর সংযুক্ত। সবুজ চত্বরে বিকাল হলেই বসে শিক্ষার্থীদের গল্প আর আড্ডার আসর। স্থাপনাটির মূলে রয়েছে ১২ ফুট উঁচু ষড়ভুজ প্লাটফর্মের ওপর ৫৬ ফুট উঁচু স্তম্ভ। শহীদ মিনারের ভিত্তি মঞ্চে পৌঁছানোর জন্য রয়েছে কতগুলো সিঁড়ি। মূল স্থাপনার পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি ফুলের বাগান। সেখানে রয়েছে নজর কাড়ার মতো ৩০ প্রজাতিরও বেশি ফুল গাছ। ডালিয়া, গাদা, চায়না গাদা, জারুল, সূর্যমুখী, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গ, নানা প্রজাতির গোলাপ, কাঠ গোলাপ, মধু মালতি, কামিনী, জবা, বেলি, সোনালু, স্বর্ণচাপা, কাগজ ফুল, রজনীগন্ধা ফুলের সমাহার শোভা পায় সেখানে। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ও মসজিদের প্রবেশ পথে দুপাশে শোভা পায় হাজারো রংবেরঙের ফুলের সমাহার। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের অবসরে এসব ফুলের সুবাসের টানে ছুটে আসেন। চলে টানা আড্ডা, দুষ্টুমি আর খুনসুটি। প্রায় ৭৫৩ একর জুড়ে এই ক্যাম্পাসে রয়েছে ৫টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট, ৯টি অনুষদের অধীনে ৫৬টি বিভাগ। ক্যাম্পাসের উত্তর পূর্ব দিক জুড়ে রয়েছে ১১টি ছাত্র হল। ৬টি ছাত্রী হল ক্যাম্পাসের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তজুড়ে রয়েছে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে গবেষকদের জন্য রয়েছে একটি ডরমিটরি। এর একটু পূর্বে গেলেই দেখা মিলবে- চারদিকে বাহারি ফুলের অপরূপ শোভা ও গাছের নরম সবুজ পাতা দিয়ে ঘেরা একটি স্তম্ভ। যা সমতল ভূমি থেকে বেশ খানিকটা জায়গা উঁচু করে বাঁধানো। তার ভিতরে একটি বড় কূপকে ঘিরে বানানো হয়েছে কংক্রিটের গোলাকার বেদি। কূপের গভীর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ৪২ ফুট উচ্চতার চৌকোণা ইটের স্তম্ভ। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধমাখা মনোরম সেই স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে যেকোনো দর্শনার্থীর চোখে ভেসে ওঠে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস; পাকিস্তানি মিলিটারি আর তাদের এদেশীয় দোসরদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ভয়াল স্মৃতি। নাম না জানা অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ। বধ্যভূমি থেকে পশ্চিম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর-পশ্চিম কোণে, রেললাইনের খানিকটা আগেই প্রায় ১০ একর জমির ওপর আছে একটি গার্ডেন। গার্ডেনের ভিতরে ঢুকে একটু সামনে এগোতেই নজর কাড়বে উপরে সবুজ আর নিচে টকটকে খয়েরি রঙের পাতাবিশিষ্ট বাইকালার গাছ। এর ডানেই গ্রিন হাউস। হাউসের ভিতরে নিবিড় পরিচর্যায় বেড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রজাতির স্পর্শকাতর গাছ। গ্রিন হাউসের ঠিক পেছনেই বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সবুজের সমারোহ। সেখানে রয়েছে দুর্লভ প্রজাতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিভিন্ন প্রজাতির কয়েক হাজার গাছ। বৈচিত্র্যময় এমনই সব গাছ প্রকৃতির স্বতন্ত্র রূপে শোভিত। গাছগুলো একদিকে গার্ডেনটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে কয়েকগুণ। বর্তমানে গার্ডেনটিতে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার গাছ। এর মধ্যে শনাক্ত করা গেছে ৬৯০ প্রজাতির গাছ। বর্তমানে এখানে রয়েছে ক্যাননবল, নাগলিঙ্গন, কোলপানচ, লালকোচ, ভূয়কুমরা, পকেটটব, বৃদ্ধনারকেলসহ আরও অনেক দুর্লভ প্রজাতির গাছ। বছর জুড়েই গাছ-গাছালির মাতৃছায়া, পাখির কলকাকলি ও ফুলের গন্ধে সুবাসিত থাকে মতিহারের সবুজ চত্বর। বরেন্দ্রের লালমাটি চিরে গড়ে ওঠা এই ক্যাম্পাসকে শীতল করে বৃক্ষের সবুজ। ক্যাম্পাসের নির্মল বাতাসে মিষ্টি গন্ধ ছড়ায় রঙিন ফুল। সেই সঙ্গে ফুলের মৌ মৌ গন্ধে গুঞ্জন ছড়ায় মৌমাছি। সে কারণেই প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রথম পছন্দ মতিহারের এই ক্যাম্পাস।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর