সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
সীতাকুণ্ডে অজ্ঞাত রোগ

সমতল বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ত্রিপুরাপল্লী বাসী

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড মধ্যম সোনাইছড়ির ত্রিপুরা পল্লী। মাত্র তিন কিলোমিটারের ব্যবধানে আছে সমতল এলাকা। কিন্তু ত্রিপুরা পল্লীর বাসিন্দাদের সঙ্গে সমতলে বসবাসকারীদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা নিজেদের মতো করেই জীবনধারণ করে। নেই স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, নলকূপ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বঞ্চিত নানা মৌলিক অধিকার থেকে। অভাব-দরিদ্রতা তাদের নিত্যসঙ্গী।  হাসপাতালে ভর্তি থাকা শিশুদের স্বজনের সঙ্গে গতকাল দুপুরে কথা বলে জানা যায়, আধুনিক নাগরিক সুবিধা কী তারা সে সম্পর্কে তেমন অবগত নয়। তা ছাড়া পাহাড়ে তাদের বেড়ে ওঠা ও দৈনন্দিন জীবনাচার সম্পর্কেও কিছু বলতে অনীহা তাদের। স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ত্রিপুরা পল্লীতে ৬৫ পরিবারে আছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। সম্পূর্ণ পাহাড়ি পরিবেশে বেড়ে ওঠা। পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে বাসস্থান তাদের। অনেকটা আদিবাসীর আদলে। তারা বঞ্চিত প্রায় সব মৌলিক অধিকার থেকে। দরিদ্রতা তাদের পিছু ছাড়ে না। জীবনধারণের অবলম্বন জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ। সঙ্গে আছে অন্যের জমিতে সবজি চাষাবাদ।

সীতাকুণ্ড উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘স্বাভাবিক জীবনধারা থেকে দূরে থাকা একটি জনগোষ্ঠী এই ত্রিপুরা পল্লীর বাসিন্দারা। তারা নিজেরাই হয় তো স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই সরকারি কোনো সুবিধা গ্রহণ করে না। অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক মৃত্যুর পরও এখনো অনেকেই তার সন্তানকে হাসপাতালে নিতে চায় না। অসুস্থ শিশুকে লুকিয়েও রাখছে। লতাপাতা নিয়ে চিকিৎসা নিতেই অভ্যস্ত। এমনকি তারা সমতলবাসীদের সঙ্গেও মেলামেশা করে না।’

সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. এস এম নুরুল করিম বলেন, ত্রিপুরা পল্লীর বাসিন্দারা নিজেরাই অসচেতন। অতীতে এ পল্লীর শিশুদের টিকা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। তাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা- টিকা দিলে বাচ্চা অসুস্থ হয়ে যাবে। অথচ এ পল্লী থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে একটি টিকা কেন্দ্র আছে। আমরা মনে করি, তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতায়  উন্নত কাউন্সিলিং দরকার।  

স্থানীয়দের দাবি, দেশের নাগরিক হিসেবে কোনো সুবিধা পৌঁছে না তাদের দোরগোড়ায়। নেই কোনো নলকূপ। একটি নলকূপ বসানো হলেও তা নষ্ট। অধিকাংশই পান করেন পাহাড়ের ঝরনা, ছড়া, খালের পানি। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা। যত্রতত্র সম্পন্ন করে প্রাকৃতিক কাজ। টিকা কী- তাও জানে না অনেকে। অভিভাবকরা অশিক্ষিত, অসচেতন ও অভাবের তাড়নায় এসব বিষয়ে কোনো খবর রাখেন না। অসুস্থ হলে বৈদ্য-কবিরাজই ভরসা। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে কুসংস্কার। সমাজের মূলধারা থেকেও বিচ্ছিন্ন তারা। নিজেদের গড়া প্রথা, সমাজে বিশ্বাসী। 

বৃদ্ধ মতি ত্রিপুরা বলেন, আমরা দীর্ঘকাল ধরে এই পাহাড়ে আমাদের মতো করেই বাস করে আসছি। শিশুরাও আমাদের মতো করে বড় হচ্ছে। তারা পড়ালেখা করতে পারে না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আমরা বৈষম্যের শিকার হই। আমাদের কেউ কোনো রোগে- ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হয়। 

এদিকে, গতকালও নতুন করে ত্রিপুরা পল্লীর মানিক ত্রিপুরা নামের একজন অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে ফৌজদারহাট সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মোট ৮৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে গত বুধবার ত্রিপুরা পল্লীতে অজ্ঞাত রোগে একদিনেই চার শিশুসহ এক সপ্তাহে ৯ শিশু মারা যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর