বুধবার, ১৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রতিরোধ প্রস্তুতির অভাবই চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ

সিটি করপোরেশনের সেবা প্রশ্নবিদ্ধ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

রাজধানীতে সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে চিকুনগুনিয়া। রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে মশাবাহিত এ ভাইরাস জ্বর ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য জেলায়ও। নরসিংদী, গোপালগঞ্জসহ প্রায় সাতটি জেলায় পাওয়া গেছে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী। ঘরে ঘরে মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলেও একে মহামারী বলতে নারাজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আর এ রোগ প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করেছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

সাত জেলায় ছড়িয়েছে চিকুনগুনিয়া : ঢাকার বাইরে কমপক্ষে আরও সাতটি জেলায় চিকুনগুনিয়ার রোগী পেয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। জেলাগুলো হলো নরসিংদী, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নেত্রকোনা ও জয়পুরহাট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে নরসিংদীতে। অন্য জেলাগুলোয়ও একজন-দুজন করে রয়েছেন। এ ব্যাপারে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘এ জেলাগুলো থেকে আমরা লিখিতভাবে রোগীর কথা জেনেছি। লক্ষণ দেখে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এরা চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত। তবে ওইসব জেলায় চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।’ নরসিংদী জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঈদের পর থেকে আমরা প্রতিদিন দু-এক জন করে চিকুনগুনিয়া উপসর্গ রয়েছে এ রকম রোগী পাচ্ছি। এ পর্যন্ত ১২ জনের তালিকা আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। তবে আমাদের যেহেতু চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করার যন্ত্রপাতি নেই তাই চিকুনগুনিয়া কিনা তা শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।’

আইইডিসিআরে গত সাড়ে তিন মাসে প্রায় ৩ হাজার মানুষ চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা করিয়েছেন। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৬৪৯ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। চিকুনগুনিয়া বিষয়ে দুটি মুঠোফোনে পরামর্শ সেবার ব্যবস্থা করেছে আইইডিসিআর। ০১৯৩৭০০০০১১ ও ০১৯৩৭১১০০১১ নম্বর থেকে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে বলে আইইডিসিআর জানিয়েছে। চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কমিটি : স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও কীটতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতীয় চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ কমিটি’ গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কমিটির সদস্য ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চিকুনগুনিয়া নতুন রোগ হওয়ায় মানুষ এ বিষয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই এ কমিটির কাজ হলো চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা, এ সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদফতরে তথ্য এবং মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে পরামর্শ দেওয়া। আরও আগে সিটি করপোরেশন এ কর্মসূচি হাতে নিলে চিকুনগুনিয়া প্রকোপ কমানো যেত কিনা— এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে সরকারি কাজে ফাইল দেওয়া-নেওয়ায় অনেক সময় চলে যায়। কখন প্রস্তুতি নিলে নিয়ন্ত্রণ করা যেত তা এভাবে বলা মুশকিল। তবে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া রোগী আমরা কম পাচ্ছি। কিন্তু জ্বর-পরবর্তী ব্যথার সেবা নিতে অনেকেই আসছেন।’ আগাম প্রস্তুতির অভাব সিটি করপোরেশনের : ২৮ এপ্রিল ‘বাড়ছে নতুন রোগের প্রকোপ’ শিরোনামে বাংলদেশ প্রতিদিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে চিকুনগুনিয়া রোগে রাজধানীবাসীর আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এরপর এ রোগের ফলোআপে করা হয় আরও বেশকিছু সংবাদ। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তখন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিষটি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে সিটি করপোরেশন। এরপর জুন থেকে অল্পবিস্তর শুরু হয় মশা নিধন কার্যক্রম। কিন্তু তত দিনে প্রকোপ আকার ধারণ করেছে চিকুনগুনিয়া। এ রোগ রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ঘরে হানা দিলেও একে মহামারী বলতে নারাজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে এ রোগের বিস্তারে সিটি করপোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ১১ জুলাই এক সভায় মন্ত্রী বলেন, ‘তাদের (সিটি করপোরেশন) অদক্ষতায় রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া রোগের বিস্তার ঘটছে। রাজধানী পরিষ্কার রাখা আমাদের কাজ নয়। রাজধানী পরিষ্কার রাখতে ও মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতার অভাবে নগরীতে চিকুনগুনিয়া রোগের বিস্তার ঘটছে।’ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের সমালোচনা করে বলেন, চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার দায়দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। রাজধানীবাসী কয়েক সপ্তাহ ধরে চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দুটি সিটি করপোরেশন মশার বংশ বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা নগরীর জলাশয়গুলো সময়মতো পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুই সিটি মেয়রের বক্তব্য : চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ প্রস্তুতি এবং কর্মসূচি বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সিটি করপোরেশন। তবে এ প্রস্তুতি আগে নিলে রোগের প্রকোপ কমানো যেত কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন বলেন, ‘আসলে এ রোগটি একদমই নতুন হওয়ায় আমাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। ২১ মে প্রথম বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এ রোগ সম্পর্কে জানি এবং কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করি। এর পর থেকে মশা নিধন কার্যক্রম প্রতিদিন পরিচালনা করা হচ্ছে। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে নগরবাসীকে সচেতন করা হচ্ছে। আর সর্বশেষ ডিএসসিসির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এ এলাকার ২৮টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও ৩টি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া রোগীদের ফ্রি সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’

চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে মশা নিধন কার্যক্রম তিন গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে উল্লেখ করে মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘আমাদের কাউন্সিলররা নিজেরা উপস্থিত থেকে মশা নিধনে কাজ করছেন।

 এজন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচজন করে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ করেছি এবং ৫টি পিকআপ কেনা হয়েছে। এর পাশাপাশি সচেতনতামূলক র‌্যালি, মতবিনিময় তো চলছেই। রাজধানীতে ডেঙ্গু যখন প্রথম দেখা দেয় তখন ৯০ জন মারা গিয়েছিলেন। শুরুর দিকে এর ভয়াবহতা বুঝতে না পারলেও এখন আমরা এর মোকাবিলায় পুরোপুরি প্রস্তুত। বিজ্ঞজনেরা বলছেন, বাসাবাড়ির স্বচ্ছ পানিতে এসব মশার বংশ বিস্তার ঘটছে। তাই বলা যায়, খাল-বিলের নোংরা পানির মশা এ রোগ বিস্তারে দায়ী নয়। কিন্তু তাই বলে এ ব্যাপারে আমাদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর