শুক্রবার, ২১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

কনটেইনার ও জাহাজ জট কমাতে নানা উদ্যোগ

নতুন টার্মিনাল নির্মাণের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম


কনটেইনার ও জাহাজ জট কমাতে নানা উদ্যোগ

চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ও জাহাজ-জট কমাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জট নিরসনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্থবির হয়ে পড়া বন্দরের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনবে এমন দাবি সংশ্লিষ্টদের।

এদিকে বন্দরের কনটেইনার ও জাহাজ-জটের সাত কারণ চিহ্নিত করেছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। জটের কবলে পড়ে বার বার স্থবির হয়ে পড়ছে দেশের আমদানি-রপ্তানির অন্যতম এ প্রবেশদ্বার। এতে করে ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তেমনি সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বন্দরের। যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে এ জট তৈরি হচ্ছে। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পুরোপুরি জটমুক্ত হতে আরও দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য এম এ লতিফ এমপি বলেন, ‘জাহাজ ও কনটেইনার

জট নিরসনে করণীয় বিষয়ে আলোচনা করতে বৃহস্পতিবার দীর্ঘ বৈঠকে বসে সংসদীয় কমিটি। বৈঠকে জট নিরসনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে জেটি নির্মাণ, রাবার

টায়ার ক্রেন ক্রয়সহ নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুব আলম বলেন, ‘বন্দরে জেটির সংখ্যা না বাড়ানোর কারণে জাহাজ ও কনটেইনার জট সৃষ্টি হচ্ছে বার বার। এ জট থেকে মুক্ত হতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জেটি ও             কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে।’ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) জাফর আলম বলেন, ‘বন্দরে জেটির সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজেট এবং বিভিন্ন ছুটির আগে জাহাজগুলো জটের কবলে পড়ে। এ জটের জন্য কোনোভাবেই বন্দর কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। তবে গত বছরের চেয়ে এবার জট কমেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যত দিন বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে না, তত দিন এ জট লেগেই থাকবে। এ জট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে আরও দু-তিন বছর লাগবে।’ বন্দর সূত্রে জানা যায়, জটের কবলে পড়ে স্থবির হয়ে পড়া বন্দরের গতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ও বন্দর কর্তৃপক্ষ। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে নতুন জেটি নির্মাণ, ক্রেন ক্রয়, রাতে জোয়ারের সময় বন্দর চ্যানেলে জাহাজ চলাচল চালু রাখা, আনোয়ারা উপকূলে সার ওঠানো-নামানোর জেটি পণ্য খালাসের কাজে ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা, বন্দর চত্বরে পড়ে থাকা তিন হাজার কনটেইনার অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া, নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল-২ খুলে দেওয়া, কনটেইনার ওঠানামার জন্য হারবার ক্রেন ভাড়া করা এবং বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া অন্য ছুটি না দেওয়া। বন্দর ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কনটেইনার ও জাহাজ-জটের জন্য সাত কারণ চিহ্নিত করেছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে—প্রতিবছর ১৮ থেকে ২০ শতাংশ হারে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাড়লেও সে হারে বাড়েনি বন্দরের সক্ষমতা; বন্দরের সক্ষমতা না বাড়ার কারণে পণ্য ওঠানামায় গতি আসেনি, তাই আগের গতিতে পণ্য ওঠানামার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে কনটেইনার ও জাহাজ-জট; কাস্টমস পুরোপুরি আধুনিকায়ন না হওয়ায় এবং নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডিংয়ের ফাইল চালাচালি হয় ধীরগতিতে, ফাইল চালাচালিতে গতি ধীর হওয়ায় বন্দর থেকে কনটেইনার খালাস করতে সময় লাগে, এতে করে সৃষ্টি হয় কনটেইনার জট। এ ছাড়া গ্র্যান্ডিং ক্রেন পর্যাপ্ত না থাকা, জেটি সংকট, পণ্য শতভাগ পরীক্ষার নামে সময়ক্ষেপণ, বন্দরে কনটেইনার রাখার মতো জায়গা না থাকা এবং নতুন কোনো কনটেইনার টার্মিনাল চালু না হওয়া জটের অন্যতম কারণ। মূলত কনটেইনার জটের কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে জাহাজ-জট। ৩৬ হাজার ৩৫৭টি কনটেইনার ধারণক্ষমতার চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ শতাংশ হারে জায়গা খালি রেখে কার্যক্রম পরিচালনার কথা থাকলেও প্রায় সময় বন্দরে কনটেইনার থাকে ৩৬ হাজারের ওপরে। জাহাজ ও কনটেইনার জটের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের।

চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রুত জেটি বাড়ানোর সুপারিশ : দিনরাত পণ্য খালাস হবে চট্টগ্রাম বন্দরে। এজন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে বন্দরের কাস্টমস, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব অফিস। সংসদীয় কমিটিকে এ বিষয়ে অবহিত করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। পণ্য খালাসের ধীরগতির কারণে সমুদ্রের বহির্নোঙরে জাহাজ-জটের কারণে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের আমদানি ব্যয়। ফলে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের দাম। এ সমস্যা নিরসনে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনায় এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ২৪ ঘণ্টা বন্দর চালু রাখার কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ১ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী এ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। কমিটি চলমান সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য দ্রুত জেটি বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। সংসদ ভবনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বন্দর নিয়ে আলোচনার পর এ সুপারিশ করা হয়। কমিটির সভাপতি মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীরউত্তম) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের বন্দরের পরিসর ছোট। কিন্তু সরকারের উন্নয়নের টার্গেট পূরণ করতে হলে দ্রুত বন্দরের জেটি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চলমান ব্যবস্থায় বন্দরের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ এক শিফটে পণ্য খালাসের ধীরগতির কারণে সমুদ্রের বহির্নোঙরে বেড়ে যায় জাহাজ-জট। বেড়ে যায় আমদানি ব্যয়। এসব নিয়ে এক বছর ধরে বন্দরের অপারেশন ডাবল শিফট করার সুপারিশ করে আসছি। কিন্তু ডাবল শিফটের জন্য বন্দরের কাস্টমস ও ব্যাংক ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের সম্মতির অভাবে বিষয়টি আটকে ছিল। ফলে এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিই। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ায় বিষয়টি দ্রুত কার্যকর হয়। এতে বিদেশ থেকে আনা চালসহ অন্যান্য পণ্য দ্রুত খালাস করা সম্ভব হবে এবং বন্দরে গতিশীলতা ফিরে আসবে।’

আটক প্রকৌশলীকে অপসারণের সুপারিশ আমলে নেয়নি মন্ত্রণালয় : এদিকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার সময় আটক নৌপরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলামের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কমিটি। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি তুলেছিলেন সভাপতি নিজেই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ওই ব্যক্তিকে তখন অপসারণ করা হলে আজ সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। অথচ সেই সময় মন্ত্রণালয় তার পক্ষ নিয়েছিল।’ কমিটির সদস্য এম আবদুল লতিফ বলেন, ‘প্রকৌশলীকে অপসারণ করলে তাকে নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হতো না।’ জানা যায়, কমিটি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় তাকে অপসারণের সুপারিশ করে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ওই দুর্নীতিবাজের পক্ষ নিয়ে তখন বলেছিল, ‘তিনি চলে গেলে সেখানে কাজ করার মতো আর কেউ নেই।’

সংসদ সচিবালয় জানায়, কমিটি নদীর দখল রোধ ও নদীর দূষণের মাত্রা হ্রাসের লক্ষ্যে পৃথক আদালত প্রতিষ্ঠা এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণকারী কোম্পানিগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করে। এ সময় বৈঠকে বিআইডব্লিউটিএ ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কে কমিটিকে অবহিত করা হয়।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীরউত্তম)। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, তালুকদার আবদুল খালেক, মো. আবদুল হাই, মো. নূরুল ইসলাম সুজন, এম আবদুল লতিফ, মো. আনোয়ারুল আজীম (আনার) ও মমতাজ বেগম অ্যাডভোকেট বৈঠকে অংশ নেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর