শিরোনাম
শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

শিল্পায়ন-বাণিজ্যে গতি বাড়ছে

শিল্প-কারখানা স্থাপনে জমি কিনছেন ব্যবসায়ীরা ♦ গড়ে উঠছে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

রুহুল আমিন রাসেল ও সঞ্জয় কুমার দাস, পটুয়াখালী থেকে ফিরে

শিল্পায়ন-বাণিজ্যে গতি বাড়ছে

দখিনের জানালা ১

দখিনা অর্থনীতির আশাজাগানিয়া দুই বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা সেতু ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাজ এগোচ্ছে দ্রুতগতিতে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গতি বাড়ছে শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের। শিল্প-কারখানা স্থাপনে বিপুল পরিমাণ জমি কিনছেন ব্যবসায়ীরা। গড়ে উঠছে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আসছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। উন্মোচিত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত।

জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা তাদের নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য পায়রা বন্দরে জমি কিনতে শুরু করেছেন। জমির দামও এরই মধ্যে ২০-২৫ গুণ বেড়ে গেছে। ১০ হাজার টাকার জমি এখন ২ থেকে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শিল্পের জন্য প্রধান প্রধান সড়কের পাশে যে ধরনের জমি দরকার, তাও কিনে রাখছেন ব্যবসায়ীরা। আবার দেশের কোনো কোনো শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী পায়রায় শিল্প স্থাপনের জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। নাভানা, গাজী, পারটেক্স, মদিনা, আজমত গ্রুপের মতো প্রায় অর্ধশত বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পায়রা, কুয়াকাটাসহ আশপাশে জমি কিনেছে।

জানা গেছে, ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর দুই পাশে বিশাল এলাকা ঘিরে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র শিল্প। অনেক শিল্পপতি আর পুঁজিপতি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার আলোকে শিল্প-কারখানা স্থাপনে বিশাল এলাকা জুড়ে জমি কিনে রেখেছেন। গড়ে উঠছে অনেক স্থাপনা। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর সুফল কাজে লাগিয়ে পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়তে পারে।

এ প্রসঙ্গে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পায়রা বন্দর এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি, আংশিক হয়েছে। যেদিন পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে, তখন থেকেই পায়রা ও মংলা বন্দর পুরোপুরি ব্যবহার সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে এখনই সরকারের উচিত হবে পদ্মাপাড় ও পায়রা বন্দর এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়নের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ হাতে নেওয়া। পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (পিসিসিআই) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ময়মনসিংহের দিকে যেসব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে, তা এখন দক্ষিণাঞ্চলের দিকে ধাবিত হবে। পায়রা বন্দরকেন্দ্রিক পটুয়াখালী ও পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরের ভাঙ্গার দিকে বিপুলসংখ্যক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি ভোলা থেকে পটুয়াখালী ও বরিশালে গ্যাস সরবরাহ করতে পারে, তাহলে দু-এক বছরের মধ্যেই বেশকিছু সম্ভাবনাময় শিল্প গড়ে উঠতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে লৌহজাত ও পোশাকশিল্প। এজন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ গ্যাস। পিসিসিআই সভাপতি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিদেশি উদ্যোক্তারা জমি কেনার জটিলতার কারণে পায়রায় বিনিয়োগে আসতে পারছেন না। আমার সঙ্গে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করেছে। তারা কুয়াকাটায় রিসোর্ট ও গলফ ক্লাব তৈরি করতে চায়। তারা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু নির্ভেজাল জমি পাওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকার জমি অধিগ্রহণ করে ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করলে উভয় পক্ষ উপকৃত হবে।’ জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলার কয়েক কোটি মানুষের প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য গত বছর চীন থেকে আসা পাথরবোঝাই জাহাজ নোঙর করার মাধ্যমে স্বল্পপরিসরে বাণিজ্যিক যাত্রা করেছে পায়রা সমুদ্রবন্দর। আর আগামী বছর পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যখন গাড়ি যাবে দক্ষিণের জনপদে, তখন সেতুর নিচ দিয়ে রেলও যাবে। তাতেই দক্ষিণের অর্থনীতি চাঙা হবে। এ আশা বুকে নিয়ে বৃহৎ বৃহৎ শিল্প গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অবহেলিত এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নে আগ্রহী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা।

সরকার-ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের মতে, বহুপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে লাগবে গ্যাস। এ দুটো নিশ্চিত হলেই বাড়বে ব্যাপক কর্মসংস্থান। কমবে আয়বৈষম্য। মংলা বন্দরে আসবে গতিশীলতা। কুয়াকাটার বন্দর সচল হলে বাণিজ্য সম্প্রসারণেও পদ্মা সেতু হবে মাইলফলক। গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা হবে রপ্তানিমুখী। দারিদ্র্য নিরসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। পাশাপাশি পাটশিল্প তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। জানা গেছে, বর্তমানে পায়রা বন্দর এলাকায় বন্দর, জেটি, কনটেইনার টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি চলমান ‘পায়রা কাস্টমস হাউস’-এর জমি দ্রুত অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। পটুয়াখালী ও ভোলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে যাচ্ছে সরকার। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার আলোকে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী ঘিরে মাস্টারপ্ল্যানও তৈরি করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। এরই অংশ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু উপশহর-কাম-আবাসিক এলাকা উন্নয়ন’ প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু উপশহরে যেমন থাকবে লাখো মানুষের আবাসনের জন্য উন্নত নাগরিক জীবনের সব সুবিধা, তেমনি গলাচিপা উপজেলাসহ আশপাশ এলাকার হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে গড়ে উঠবে বিশাল শিল্পাঞ্চল। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে এখানে জমির অভাব নেই। সম্ভাবনা আছে পোশাক শিল্পনগরী গড়ে তোলার। মাঝের চরের মতো অজপাড়াগাঁয়ে সরকার গড়ে তুলতে চাইছে তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল সম্ভার বা আইটি পার্ক। আরও আছে স্কুল, কলেজ, স্টেডিয়াম, শিশু পার্ক। সব মিলিয়ে সাগরকন্যা পটুয়াখালীর গলাচিপা এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উল্লম্ফন দিতে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে সাফল্যের পর সরকার দেশের সব অঞ্চলের মধ্যে সুষ্ঠু ও সমম্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এ সেতু নির্মিত হলে বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, যশোর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। সেতুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি পদ্মা সেতু উৎপাদন বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনসহ জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়েতে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াতব্যবস্থার পাশাপাশি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াতব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সুযোগ সৃষ্টি হবে। জানা গেছে, পায়রা সমুদ্রবন্দরের পাশে প্রায় ৫০০ একর জমির ওপর স্থাপিত হচ্ছে আধুনিক শের-ই-বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক নৌঘাঁটি। এ নৌঘাঁটিতে নৌ-কমান্ডো, এভিয়েশন, জাহাজ ও সাবমেরিন বার্থিং সুবিধা থাকবে। তবে প্রায় ৬ হাজার একর এলাকাবিশিষ্ট এ বন্দর ঘিরে নানা স্বপ্ন বুনছে সরকার। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে এখানেই গড়ে উঠবে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। নির্মিত হবে সার কারখানা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড), জাহাজ নির্মাণ শিল্প, এনএলজি টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও মত্স্য প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় থাকবে উপকূলজুড়ে সবুজ বেষ্টনী ও ইকো-ট্যুরিজম। জানা গেছে, সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা পায়রা বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে উন্নীত করা সম্ভব। বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহী করতে পায়রায় নির্মিত হবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কমপ্লেক্স, জাতির পিতার ভাস্কর্য, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ইকো পার্ক ও ফরেস্ট, মেরিন ড্রাইভ, মেরিন পার্ক, সি অ্যাকোরিয়াম, স্টেডিয়াম, গল্ফ ও টেনিস কোর্ট, মসজিদ ও কনভেনশন সেন্টার। ব্যবসায়ীদের মতে, পদ্মা সেতু আর গ্যাস হলে তারা খুলনায় বসেই মংলা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করতে পারবেন। এ দুটোর অভাবেই খুলনা শিল্পায়ন হচ্ছে না। পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তৈরি পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপন সহজ হবে। যদিও ইতিমধ্যে অনেক ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠেছে। বৃহৎ বৃহৎ শিল্প গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে অনেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী কাজ করছেন। এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জমি কিনে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পদ্মা সেতু ও কুয়াকাটায় তৃতীয় গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ শেষ হলে এ এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়ন হবে। সেই শিল্পায়নের অংশ হিসেবে দক্ষিণবঙ্গের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা তৈরি পোশাক, আবাসনসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এর ফলে এ এলাকায় যেমন আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন হবে, তেমনি শ্রমিকরা ঢাকামুখী না হয়ে বরিশালমুখী হবেন। আগামীতে চট্টগ্রামের পর বরিশাল অঞ্চলই হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র।

সর্বশেষ খবর