রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঝুঁকি জেনেও কেন বসবাস পাহাড়ে

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

ঝুঁকি জেনেও কেন বসবাস পাহাড়ে

পাহাড়ে নির্বিচারে বসতি স্থাপনের কারণেই ঘটছে একের পর এক ধসের ঘটনা। পাহাড়ধসে গত ১৮ বছরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মারা গেছেন সাড়ে চার শতাধিক ব্যক্তি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাহাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করতে হবে। পাশাপাশি উচ্ছেদ ব্যক্তিদের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে কোনোভাবেই থামানো যাবে না পাহাড়ধসে মৃত্যুর এ মিছিল।

পাহাড়ধসে প্রাণহানি রোধে করণীয় বিষয়ে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ বলেন, ‘পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপিত বসতি উচ্ছেদ করতে হবে। যাদের উচ্ছেদ করা হবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।’ এ অঞ্চলে বার বার পাহাড়ধসের কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উপজাতিরা পাহাড়ে ঘর তৈরি করলেও তারা কখনো পাহাড় কাটে না। তারা আকৃতি অপরিবর্তিত রেখে পাহাড়ের উপযোগী করে ঘর তৈরি করে। তাই উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকায় ধসের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। কিন্তু সমতল থেকে যেসব লোক পাহাড়ে গিয়ে বসতি গড়ে, তারা পাহাড় কেটে ঘর তৈরি করে। তাই বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।’ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রামে পাহাড় নিয়ে চুয়েটের একটি দল দীর্ঘ সময় গবেষণা করে। ওই গবেষণায় পাহাড়ধসের মূল চারটি কারণ চিহ্নিত হয়। এগুলো হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করা, এ অঞ্চলের পাহাড়ের মাটির গঠন, নির্বিচারে কাটার ফলে পাহাড়গুলোর কোণ ৭০ থেকে ৯০ ডিগ্রিতে পরিণত হওয়া এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে নির্বিচারে গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করা।’ অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পাহাড়ে অবৈধ যেসব বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো উচ্ছেদ করতে হবে। একই সঙ্গে যাদের উচ্ছেদ করা হবে তাদের অন্যত্র পুনর্বাসন করতে হবে। নইলে ফের তারা অন্য কোনো পাহাড়ে গিয়ে বসতি স্থাপন করবে। পাহাড়ধসে প্রাণহানি রোধে পুনর্বাসনের বিকল্প নেই।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল বলেন, ‘দেশের অন্যান্য জায়গার পাহাড়গুলোর তুলনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়গুলোর বয়স কম। তাই পাহাড়গুলোর গঠন দুর্বল। দুর্বল গঠনের কারণেই বৃষ্টিতে পাহাড়গুলো ধসে পড়ছে। এ ছাড়া নির্বিচারে গাছ কাটার পর একসময় গাছের গোড়াগুলো পচে যায়। এ পচা অংশ দিয়ে পানি সহজেই পাহাড়ের ভিতর প্রবেশ করে। এটাও এ অঞ্চলের পাহাড়ধসের আরেকটা কারণ।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপনের কারণেই ধসে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটছে। পাহাড়ধসে ক্ষয়ক্ষতি রোধে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এসেছে। তাই সব সংস্থাকে সমন্বয় করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’

জিও সায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষণায় পাহাড়ধসের জন্য দুটি অন্যতম কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এ দুটির একটি প্রাকৃতিক। অন্যটি মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে। প্রকৃতিসৃষ্ট কারণ হলো, পাহাড়ের ঢালে যদি বেশি গর্ত থাকে, তখন অতিবৃষ্টিতে তা ধসে পড়ে। এ ছাড়া ভূমিকম্প, পাহাড়ের পাদদেশের নদী ও সাগরের ঢেউ থেকেও ধস হতে পারে। মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্বিচারে গাছ কাটা, মাটি কেটে ফেলা, পাহাড়ে প্রাকৃতিক খাল বা ঝরনার গতি পরিবর্তন, পাহাড়ের ঢালুতে অতিরিক্ত ভর দেওয়া এবং খনির জন্য গভীর কূপ খনন। জানা যায়, গত ১৮ বছরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে পাহাড়ধসে সাড়ে চার শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চলতি বছর চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার ও বান্দরবানে নিহত হয়েছেন ১৮০ জন। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির ঘটনাগুলোর অন্যতম হচ্ছে— ২০১৫ সালের জুনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড়ধস এবং ঢলে নিহত হন ১৯ জন, ২০১২ সালের জুনে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে পাহাড়ধসে নিহত হন ৯৪ জন, ২০১১ সালে চট্টগ্রাম নগরীতে নিহত হন ১৭ জন, ২০০৮ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম নগরীতে নিহত হন ১৪ জন, ২০০৭ সালের জুনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় নিহত হন ১২৭ জন, ১৯৯৯ সালে আগস্টে পাহাড়ধসে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নিহত হন ১৭ জন।

সর্বশেষ খবর