সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রচার শুরু বরিশাল সিটিতে প্রার্থীর ছড়াছড়ি দুই দলে

রাহাত খান, বরিশাল

প্রচার শুরু বরিশাল সিটিতে প্রার্থীর ছড়াছড়ি দুই দলে

ঢাকা, চট্টগ্রামের পর অনুষ্ঠিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এবার বরিশালসহ চার সিটি নির্বাচনের পালা। নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকলেও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে প্রচার-প্রচারণা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেক আগে থেকেই নির্বাচনকেন্দ্রিক সভা-সেমিনার, গণসংযোগসহ সাংগঠনিক নানা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিরোধী জোটের প্রধান শরিক বিএনপির নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণা না থাকলেও দলের ভিতরে ভিতরে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকে। যদিও সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেন্দ্র থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা না পাওয়ার কথা বলেছেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা।

বরিশালে ভোটের রাজনীতিতে বরাবরই এগিয়ে বিএনপি। ২০১৩ সালের ১৫ জুনের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রতিদ্বন্দ্বী শওকত হোসেন হিরণকে ১৭ হাজার ১০ ভোটে হারিয়ে ৮৩ হাজার ৭৫১ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি সমর্থিত আহসান হাবিব কামাল। কিন্তু গত প্রায় চার বছরে সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, অদূরদর্শিতা, অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অক্ষমতার কারণে নগরবাসী যারপরনাই কামালের ওপর চরম ক্ষুব্ধ, ত্যক্ত-বিরক্ত। এর দায় কিছুটা হলেও বর্তায় মেয়র পদে কামালকে সমর্থনকারী দল বিএনপির ওপর। যদিও নিজেকে সফল মেয়র দাবি করে কামাল বলেছেন, নগরবাসীকে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চেয়েও বেশি কাজ করেছেন তিনি। ভবিষ্যতে মেয়দ পদে দলের মনোনয়ন চাইবেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। আবার করপোরেশনের দ্বিতীয় পরিষদের মেয়র প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা শওকত হোসেন হিরণ আমলের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। সব মিলিয়ে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মধ্যে। সেদিক বিবেচনায় ভোটের বৈতরণী পার করতে হলে পরিচ্ছন্ন ইমেজ, গ্রহণযোগ্যতা, জনসম্পৃক্ততাসহ প্রার্থীর নানা বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীর তালিকা দীর্ঘ। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল ও সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম, প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের সহধর্মিণী সদর আসনের এমপি জেবুন্নেছা আফরোজ, ১৫ আগস্টের শহীদ সাবেক মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছোট ছেলে খোকন সেরনিয়াবাত, সাবেক এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমদ, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও চেম্ব্বার সভাপতি মো. সাইদুর রহমান রিন্টু, উদীয়মান নেতা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন এবং মহানগর শ্রমিক লীগের সভাপতি আফতাব হোসেন— প্রত্যেকেরই দলের মনোনয়নে মেয়র প্রার্থী হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। ঘনিষ্ঠজন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের সম্ভাব্য প্রার্থিতার গুঞ্জন সম্পর্কে অ্যাডভোকেট দুলাল বলেন, ‘পরিষ্কার বলে দিতে চাই, আমি মেয়র পদে ইন্টারেস্টেড নই। তবে নেত্রী যদি আমাকে যোগ্য মনে করেন, তাহলে আমি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত।’ সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের দুটি সভায় তরুণ নেতাদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক চিফ হুইপ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির বড় ছেলে সাদিক আবদুল্লাহকে মেয়র পদে দলের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি ওঠে। সভায় তরুণ নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাদিককে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য দলীয় সভানেত্রীর কাছে রেজুলেশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সিনিয়র নেতাদের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও তরুণ নেতাদের আধিপত্যের কারণে মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস দেখাচ্ছেন না কেউ। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে এমপি জেবুন্নেছা, কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক, অ্যাডভোকেট আফজাল ও মাহবুব উদ্দিন আহমদ প্রকাশ্যে দলের মনোনয়ন চাওয়ার কথা বলেছেন। মেয়র পদে সিনিয়র আরও কয়েক নেতার সাধ থাকলেও অভিব্যক্তি প্রকাশ করার উপায় নেই। হাসানাতপন্থি নেতারা মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস না পেলেও মেয়র পদে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যখন তফসিল ঘোষণা করবে তখন দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড দলীয় মনোনয়ন আহ্বান করবে। সেখানে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর দলই সিদ্ধান্ত নেবে বরিশালে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী কে।’ আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের যে কোনো পর্যায়ে মনোনয়ন দেওয়ার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার নাম সুপারিশ করল, আর কার নাম সুপারিশ করল না তা বিষয় নয়। বরিশালসহ সব সিটিতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেবেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করবে সবাই।’ দলের একাংশের নেতাদের নীরবতার কারণে সাদিক আগামীতে বরিশালের মেয়র হচ্ছেন বলে ধরে নিয়েছেন তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগমনা কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সাদিকের মেয়র হওয়ার দিন গুনছেন। এ কারণে তারা বর্তমান মেয়রকেও খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না।

তার নির্দেশও উপেক্ষিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগে নানামুখী আলোচনা থাকলেও এ মুহূর্তে মেয়র প্রার্থিতা নিয়ে ভাবছে না বিরোধী জোটের প্রধান শরিক বিএনপি। বরং সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ থাকলে তবেই নির্বাচনে যাওয়ার চিন্তাভাবনার কথা বলেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশের অপেক্ষায় থাকলেও ভিতরে ভিতরে সিটি নির্বাচনের প্রার্থী হতে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা। নির্বাচনী ‘ব্যানারে’ না হলেও দলের বিভিন্ন কার্যক্রমে সাংগঠনিক তত্পরতা বৃদ্ধি এবং নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন তারা। সেই সঙ্গে জনসংযোগ করে সমর্থন আদায়ের কাজটিও করছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিন, ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে দলের চাপে শেষ দিন মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়া দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়েদুল হক চাঁন ও মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন শিকদার জিয়া। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে মহানগর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাউকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে স্থানীয় বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ তিনজন ছাড়াও পদবিবিহীন বিএনপি নেতা বর্তমান মেয়র আহসান হাবিব কামাল আবারও দলের মনোনয়নে প্রার্থী হওয়ার প্রত্যাশা করছেন। মনোনয়ন পাওয়ার লক্ষ্যে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়িয়ে দেওয়াসহ দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলে কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন। এ ছাড়া ওয়ান-ইলেভেনের সময় সিটি নির্বাচনে মাত্র ৫০০ ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিরণের কাছে পরাজিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এস সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ এবং সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর প্যানেল মেয়র ও মহানগর বিএনপির সহসভাপতি কে এম শহীদুল্লাহ শহীদের নাম সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীর আলোচনায় আছে। সান্টু তার নির্বাচনী এলাকা গুঠিয়ায় দৃষ্টিনন্দন বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ঈদগাহ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করে জনসাধারণের বাহ্বা কুড়িয়েছেন। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা নান্দনিক এই মসজিদ দেখতে আসেন। মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ ক্লিন ইমেজের শান্ত-ভদ্র নেতা হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তারা নিজ নিজ সংসদীয় আসনে আগামীতে মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানিয়েছেন তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা।

সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থিতা সম্পর্কে দলের যুগ্ম-মহাসচিব ও মহানগর সভাপতি সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, এখনই প্রার্থিতা নিয়ে ভাবছে না তার দল। সরকার সুষ্ঠু-গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরলে তবেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যাওয়ার চিন্তা করবে বিএনপি। আর ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে নয় তার দল। নির্বাচনে যাওয়ার পরস্থিতি হলে দলের মধ্যে অনেকের নাম আলোচনায় আছে। বাইরেরও কেউ কেউ প্রার্থী হতে চান। মহানগরের ভোটার, মহানগরের ভোট, নির্বাচনও পরিচালনা করবেন মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বাইরে থেকে কোনো প্রার্থী না এনে মহানগর থেকেই কাউকে মেয়র প্রার্থী করলে সহজ বিজয় সুনিশ্চিত হবে বলে মনে করেন সরোয়ার। সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল বলেন, মহানগরের কর্মীরা সাদিকমুখী। সাদিকের সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও তার প্রতি কর্মীদের আবেগ অপরিসীম। মহানগর আওয়ামী লীগের ৩০টি ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরা চান, সাদিক আবদুল্লাহ আগামী সিটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী হোক। সাদিকের বাইরে আর কোনো নেতা মহানগর আওয়ামী লীগের কাছে প্রকাশ করেননি যে তিনি আগামীতে মেয়র প্রার্থী হবেন কিংবা তাদের কর্মতত্পরতাও দৃশ্যমান নয়। আগামী সিটি নির্বাচন সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করেন মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের তৃতীয় পরিষদের নির্বাচন হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৫ জুন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট শওকত হোসেন হিরণকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির আহসান হাবিব কামাল।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিটি করপোরেশন আইন, ২০০৯-এ বলা হয়েছে, যেদিন থেকে (মেয়র ও কাউন্সিলররা) শপথ গ্রহণ করেছেন, এর পরবর্তী পাঁচ বছর তারা দায়িত্ব পালন করবেন। বর্তমান মেয়াদ শেষে নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হলে যে-কেউ মেয়র পদে অংশ নিতে পারবেন। আর যদি মেয়াদের আগে কমিশন তফসিল ঘোষণা করে, তাহলে বর্তমান মেয়রও চাইলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তবে সেই কদিন তিনি সিটি করপোরেশনের কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। নির্বাচন সম্পন্ন হলে সরকার চাইলে মেয়াদের বাকি সময়টা তাকে দিয়ে দায়িত্ব পালন করাতে পারেন।

২০১৩ সালের ১৫ জুন নির্বাচিত হওয়ার প্রায় তিন মাস পর একই বছরের ৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়রের দায়িত্ব নেন আহসান হাবিব কামাল।

সর্বশেষ খবর