মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ইংরেজি ঝড়ে বিপর্যয়

জরুরি বৈঠক তদন্তের নির্দেশ

আকতারুজ্জামান

উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসিতে ইংরেজি বিষয়ে খারাপ ফলাফলই বিভিন্ন বোর্ডের শিক্ষার্থীদের ফলাফলকে বিপর্যয়ে ফেলেছে। বিজ্ঞান ও বাণিজ্যে শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভালো ফল করলেও ইংরেজি ঝড়ে রীতিমতো পর্যুদস্ত মানবিক বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। আর এই  নেতিবাচক ফল প্রভাব ফেলেছে বোর্ডগুলোর সার্বিক ফলাফলে। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে, এ বক্তব্য মানতে পারছেন না অনেকেই। কারণ সেটা হলে সিলেট ও বরিশালের রেজাল্ট আগের চেয়ে ভালো হওয়ার কথা নয়। এ নিয়ে চিন্তিত শিক্ষা বোর্ডগুলোর প্রধানরা জরুরি বৈঠকও করেছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পরীক্ষার ফল বিশেষ করে ইংরেজির ফল এত খারাপ কেন হলো- এর কারণ অনুসন্ধানের। বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু) খারাপ ফলের কারণ অনুসন্ধান করবে। এইচএসসির প্রকাশিত ফলাফলের বিষয়ভিত্তিক পাসের হার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলায় সারা দেশে ৯৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। আইসিটিতে পাস করেছে প্রায় ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী। রসায়ন এবং  পৌরনীতিতে পাস করেছে যথাক্রমে ৯৩.৬১ এবং ৯৪.৪০ শতাংশ। কিন্তু পদার্থ এবং হিসাববিজ্ঞানে পাসের হার ৯০ শতাংশের নিচে নেমেছে। পদার্থবিজ্ঞানে ৮৮.৮৮ শতাংশ এবং হিসাববিজ্ঞানে ৮৭.৪৯ শতাংশ পাস করেছে। সার্বিক ফলাফল নিচে নেমেছে ইংরেজির কারণে। কুমিল্লা বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, ইংরেজিতে খারাপ করায় ফল বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা বোর্ডটিতে অকৃতকার্য হওয়া পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ ইংরেজি বিষয়ে ফেল করেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ইংরেজিতে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর অধিক ফেল করেছে। তবে মানবিকের অন্যান্য বিষয়ও কুমিল্লার ফলাফলকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।  কুমিল্লায় মানবিক বিভাগে ৪২ হাজার ৩৯৩ জন ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে মাত্র ১৬ হাজার ২৭২ জন। শতকরা হিসেবে তা মাত্র ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অথচ কুমিল্লা বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৭২ দশমিক ৭২ শতাংশ। ইংরেজি বিষয়ে শুধু কুমিল্লাই নয়, অন্যান্য বোর্ডও খারাপ করেছে। ইংরেজিতে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৬.৬৬ শতাংশ। রাজশাহীতে ৭৪.৭১, যশোরে ৭২.৯৫, চট্টগ্রামে ৭৩.১০, বরিশালে ৭২.৪১, সিলেটে ৮২.৩৩ ও দিনাজপুরে ৭০.৩০ শতাংশ। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান বলেন, এবার খারাপ ফলের পেছনে ইংরেজি বড় ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা  বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার গত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। তবে আরও কয়েকটি কারণ আছে। গড়পড়তা নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে আমরা পরীক্ষকদের সতর্ক করেছিলাম। প্রধান পরীক্ষকরা ১২ শতাংশ খাতা দেখেন কিনা তা ভালোভাবে মনিটর করা হয়। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবদুল খালেক বলেন, ইংরেজিতে ফলাফল বিপর্যয় ঘটার কারণেই মূলত এ শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল খারাপ হয়েছে। ইংরেজিতে খারাপ করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা করছি। এসব কলেজের সমস্যা কোথায় তা খুঁজে বের করে সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল আলিমও প্রায় একই কথা বলেছেন। দেখা গেছে, ইংরেজিতে যেসব বোর্ডের পাসের হার ভালো, সেগুলো মোট পাসের হারও এগিয়ে। যেমন- ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সিলেটে পাসের হার সবচেয়ে বেশি ৭২ শতাংশ। এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হারও বেশি। তবে ইংরেজিতে সবচেয়ে ভালো করেছে মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। ওই বোর্ডের সার্বিক পাসের হারও ৯ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে বেশি। শুধু তাই নয়, এবার ব্যতিক্রম হিসেবে আগের বারের চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি পাস করেছে সিলেটে। এ প্রসঙ্গে সিলেট শিক্ষা বোডের চেয়ারম্যান এ এস এম গোলাম কিবরিয়া বলেন, ইংরেজিসহ কঠিন বিষয়ে বেশি যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণত এসব বিষয়ে শিক্ষার্থী  বেশি ফেল করে। এ ছাড়া চার জেলায় চারটি সচেতনতামূলক সেমিনার করা হয়েছে। এটাও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইংরেজি শেখানোর মতো পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন শিক্ষক দেশে নেই। সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকরা তুলনামূলক দক্ষ হলেও বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকদের ইংরেজি শেখানোর দক্ষতা খুব কম। আমি এমন অনেক কলেজের নাম জানি যেগুলোতে ইংরেজি ক্লাস অন্য বিভাগের শিক্ষকরা নিয়ে থাকেন। এসব কারণেই ইংরেজিতে খারাপ করছে ছাত্রছাত্রীরা। প্রখ্যাত এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, সৃজনশীলে শিক্ষকদের দক্ষতা, প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকরা ক্লাসনির্ভর নয়, অনেকাংশে কোচিংনির্ভর। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, একসময়ে খাতা অতি বা অবমূল্যায়িত হতো। কিন্তু যখন এ নিয়ে কথা উঠেছিল, তখন তিনি তা স্বীকার করেননি। কত সুন্দরভাবে নেওয়া গেল, মান কীভাবে বণ্টন করা গেল আর জিপিএ-৫ কত পার্সেন্ট পেল সেটাকেই বড়াই করে বলা হতো। অথচ এখন বলা হচ্ছে আমরা মূল্যায়নের একটা সঠিক পদ্ধতি বের করেছি।’ এইচএসসি পরীক্ষার এই ফলাফল কমে যাওয়াকে ফল বিপর্যয় বলতে নারাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান। প্রথিতযশা এ শিক্ষাবিদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এবারের এই ফলাফলকে বিপর্যয় বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি গত পাঁচ বা ছয় বছরে হাইব্রিড ফল প্রকাশ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার চেয়ে বেশি নম্বর দেওয়া হয়েছিল। তাই তাদের জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার বেড়েছিল। তাই সে ফলাফলের ওপর আমরা নির্ভর করতে পারিনি। এ বছরও যথাযথভাবে খাতা মূল্যায়ন হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি, এবারের ফল সত্যের কাছাকাছি গেছে। এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশ্নপদ্ধতি প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করা উচিত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর