শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিশ্ব বাঘ দিবস আজ

রয়েল বেঙ্গল টাইগার কমছে সাত কারণে

মোস্তফা কাজল

রয়েল বেঙ্গল টাইগার কমছে সাত কারণে

মহাসংকটে সুন্দরবনের বাসিন্দা রয়েল বেঙ্গল টাইগার-বাঘ। প্রধানত সাত কারণে বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এসবের মধ্যে বাঘ শিকার ও দেহাবশেষ পাচার, বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চল ধ্বংস, বাঘের আবাসস্থলের চারপাশে শিল্প ও কল-কারখানা স্থাপন, বাঘ শিকার করার জন্য ফাঁদ ও অবাধে বিষটোপের অপব্যবহার, বাঘের খাদ্য জাতীয় প্রাণী শিকার ও মাংস বাজারজাতকরণ, বাঘ ও মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়া এবং বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চল দিয়ে যানবাহন ও নৌ চলাচল বেড়ে যাওয়া সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাঘ বিশেষজ্ঞরা। সুন্দরবনের বাঘের স্বাভাবিক জীবনচক্রের জন্য যে স্বাদু পানি, শিকার ও গহিন জঙ্গল এবং নিরুপদ্রব প্রজনন ব্যবস্থা থাকা দরকার তার কোনোটাই বর্তমানে যথেষ্ট নয়। সব মিলিয়ে প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বাঘের প্রজনন প্রক্রিয়া ঝুঁকিতে পড়েছে। এসব কারণে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিষ টোপে বাঘ শিকার, শাবক পাচার, পিটিয়ে ও গুলি করে বাঘ হত্যার ঘটনা। কয়েক বছর আগে সাতক্ষীরার বন থেকে চুরি করা তিনটি ব্যাঘ্র শাবক ঢাকায় ধরা পড়ার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে, একাধিক পাচার চক্র শুধু বয়সী বাঘ হত্যা করে চামড়া বিক্রি করে থাকে তা-ই নয়, তারা শাবকও দেশে-বিদেশে পাচার করে আসছে।

বাঘ বাঁচাতেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩টি দেশ একসঙ্গে প্রতি বছরের ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করে থাকে। এবারের বিশ্ব বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘বাঘ আমাদের গর্ব। বাঘ রক্ষা করব’। আজ বাগেরহাট জেলায় বাঘ দিবসের আলোচনা সভা ও ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হবে। জানতে চাইলে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাঘ সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ। বাঘের অস্তিত্ব রক্ষা করা হলে এ মহামূল্যবান সম্পদ রক্ষা হবে। বর্তমান সরকার সুন্দরবন রক্ষায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। বাঘের পাশাপাশি অন্য বন্যপ্রাণী রক্ষা, সুন্দরবনের জন্য স্বতন্ত্র ফোর্স গঠন এবং টহল কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়েছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, সুন্দরবনে বাঘের জীবনচক্র স্বাভাবিক থাকলে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৫ সালের বাঘশুমারিতেও এর সংখ্যা ১০৬ এর বেশি পাওয়া যায়নি। এর আগে দফায় দফায় এই সংখ্যা কমবেশি হলেও বাঘের সংখ্যা এখনো কোনোভাবেই বাড়ছে না। এ জন্য ক্যাপটিভ বাঘ শাবক লালন-পালনের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি বিদেশ থেকে বাঘ আমদানির ওপর জোর দেন তিনি। বাঘ বিশেষজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত উপ-প্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে বলেন, সুন্দরবনে পুরুষ বাঘ সংখ্যায় বেশি হলেও বাঘিনীর সংখ্যা কম। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি বাঘিনী একবারে দুই থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। একেকটি বাঘিনী সচরাচর দুবার বাচ্চা ধারণ করে থাকে। এর স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া ও নিরুপদ্রব আবাসন নিশ্চিত করা গেলে বাঘের সংখ্যা এতদিনে আরও বৃদ্ধি পেতে পারত। সুন্দরবনের ভারতীয় এলাকায় এ ধরনের নিরাপদ প্রজনন ব্যবস্থা থাকায় সেখানে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে এমন তথ্য বন বিভাগের বন্যপ্রাণী বিভাগ জানতে পেরেছে। জানা গেছে, বাঘিনী বাচ্চা দেওয়ার পর শাবকের ওপর নজর পড়ে বাঘের। যে কোনোভাবে বাচ্চাগুলো খেয়ে ফেলার জন্য সব সময়ই তৎপর থাকে বাঘ। জানা যায়, এ অবস্থায় জন্ম দেওয়ার পর থেকে বাঘিনী শিকার ধরা ছাড়াও স্বাভাবিক চলাফেরা সম্পূর্ণ বন্ধ করে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকে। এ সময় বাঘিনী চারদিকে নির্ঘুম দৃষ্টি রাখে। শাবকগুলো মায়ের সঙ্গে চলাফেরা করার যোগ্য হয়ে ওঠা পর্যন্ত এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বাঘিনী। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে তিনটি ব্যাঘ্র শাবক কীভাবে পাচারকারীরা মা বাঘিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অপহরণ করেছিল তা ভাবিয়ে তুলেছিল সবাইকে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলে ৩৯টি বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বাঘ আটক হয় চারটি। বাঘ নিয়ে গবেষণাকারীরা বলেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় বাঘের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এলাকার সুন্দরবনের বাঘ স্থান পরিবর্তন করে থাকে। বনে গভীর জঙ্গল না থাকায় বাঘ তার নিরাপদ আবাসন হারিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাঘ সচরাচর নিস্তব্ধ এলাকা পছন্দ করে থাকে। অথচ সুন্দরবনে নানা ধরনের শব্দ বিশেষ করে পটকাবাজি এবং ব্যাঘ্র এলাকায় মানুষের পদচারণা বাঘের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। এ ছাড়া ১৯৮৮-এর ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭-এর সিডর ও ২০০৯-এর আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের মুহূর্তেও বাঘের জীবন হয়ে পড়েছিল বিপন্ন। এ সময় অনেক বাঘের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। বাঘের শিকার হিসেবে বনে যে শূকর দরকার, তা যথেষ্ট নয়। অপরদিকে বয়সী বাঘের পক্ষে দ্রুতগতির হরিণ ধরা খুবই কঠিন। মিষ্টিপানি আর শিকারের সন্ধানে বাঘ নিরুপায় হয়ে নদী পার হয়ে লোকালয়ে চলে আসে। লোকালয়ে আসার পর তার পরিণতি হয় নিশ্চিত গণপিটুনি অথবা গুলিতে মৃত্যু। এ ছাড়া নানা কারণে বাঘ দৈহিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় প্রজনন ক্ষমতাও হারাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর