বুধবার, ২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

পার পেয়ে যায় দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকাররা

বন্ধ হচ্ছে না ঋণ জালিয়াতি, নেই শাস্তি নেই তদারকি

আলী রিয়াজ

কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিংয়ের অভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকারদের কোনো শাস্তিই হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় জালিয়াতির তদন্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক শাস্তির সুপারিশ করে। এরপর এসব সুপারিশের বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা দেখার কেউ নেই। অনেক সময় এসব সুপারিশের তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে সাময়িক বরখাস্ত হলেও কয়েক দিন পরই সপদে বহাল হয়ে একই দুর্নীতি করে যাচ্ছেন দুর্নীতিগ্রস্তরা। জালিয়াতি-অনিয়মে জড়িত প্রমাণ পাওয়ার পরও কারও কোনো শাস্তি না হওয়ায় সমানতালেই চলছে দুর্নীতি। এসব কর্মকর্তার যোগসাজশে ভুয়া কোম্পানিকে ঋণ প্রদান আটকানো যাচ্ছে না। ফলে প্রতি মাসেই বাড়ছে হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েও ঠেকাতে পারছে না এসব অনিয়ম। বিভিন্ন ব্যাংকসূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক ব্যাংকিং ইতিহাসে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারিতে জড়িত রাষ্ট্রায়ত্ত একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা চাকরিচ্যুত হন। এসব কর্মকর্তার অধিকাংশ এখন বহাল তবিয়তে ফিরেছেন। অনেকের পদোন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া সরাসরি বিভিন্ন জালিয়াতির কোনো শাস্তি সাম্প্রতিক সময়ে হয়নি। যেসব জালিয়াতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করেছে এবং শাস্তির সুপারিশ  করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওইসব সুপারিশ একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে নিজের পদেই ফিরে এসেছেন তারা। গত ছয় মাসের ব্যবধানে জালিয়াতির অভিযোগে দুদক বিভিন্ন ব্যাংকের ৮২ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের কয়েক মাস পরই এসব কর্মকর্তা যার যার পদেই ফিরেছেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অপরাধে তৎকালীন ভবন শাখা ও লোকাল শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ঘটনায় ১১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়। ১১ জন কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র চারজনকে গ্রেফতার করা হয় এবং সাময়িক বরখাস্ত করা হয় যারা ছিলেন সে সময় তুলনামূলক নিচের পদে। বাকি সাতজনের নাম অভিযোগের তালিকা থেকেই বাদ দেওয়া হয়েছে। সে সময় ভবন শাখার জিএম সালাম আজাদ যার বিরুদ্ধে বিসমিল্লাহ গ্রুপে ঋণ জালিয়াতি সরাসরি সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক শাস্তি সুপারিশ করে। যিনি হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে সোনালী ব্যাংকেও অভিযুক্ত ছিলেন। তিনি বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে ব্যাংকের আরও বড় পদে আসীন হয়েছেন। প্রচার রয়েছে আবারও পদোন্নতি হতে পারে ওই কর্মকর্তার। এ ছাড়া আইসিডি বিভাগের জিএম ফখরুল ইসলাম, লোকাল শাখার জিএম আবদুল আউয়াল প্রশাসন বিভাগের জিএম পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সবাইকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ২০১৬ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে বিভিন্ন অনিয়মে ২৬ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এসব কর্মকর্তার এখন কয়েকজন বাদে বেশির ভাগই বহাল হয়েছেন নিজের পদে। গত জানুয়ারিতে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৩ জনকে পদোন্নতি দিয়ে বিভিন্ন শাখার ব্যবস্থাপক করা হয়েছে। ১২৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোনালী ব্যাংকের জিএম নেপাল চন্দ্র সাহা, ডিজিএম সমীর কুমার দেবনাথ, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার শেখ তৈয়াবুর রহমান, সহকারী কর্মকর্তা কাজী হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাদের ওই মামলাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই দায়িত্বে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল হামিদ, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিজানুর রহমানকে দুর্নীতির অভিযোগে সরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক শ কোটি টাকার ওই জালিয়াতির ঘটনায় আরও সাত কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। যাদের বিরুদ্ধে দুদকে মামলাও হয়। ওই সুপারিশে ডিজিএম জওহর লাল রায়, এজিএম কিবরিয়াকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর দুজনেরই পদোন্নতি হয়েছে। সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে ওই কর্মকর্তারাই ব্যাংকের ঋণ প্রদানের নিয়ন্ত্রক।

রূপালী ব্যাংকের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কাউকে চাকরিচ্যুত না করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের সাবেক জিএম নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে শাস্তির সুপারিশ করা হয়। সম্প্রতি ওই কর্মকর্তাকে ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে কৃষি ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত সত্যজিৎ বিশ্বাসের শত কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ ব্যাংকই তদন্ত কমিটি করে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করা হয়। তাকে চাকরিচ্যুত না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি এই ব্যাংকটির জনসন রোড শাখায় একটি সৌদি অটো রাইস মিল নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই ঋণ প্রদানের কারণে সেখানকার জিএম কেতাব আলী মণ্ডলকে পদাবনতি করার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এখন তিনি একটি শাখার ঋণ পর্যালোচনার দায়িত্বে রয়েছেন। একই শাখার ডিজিএম মাকসুুদুর রহমানকে জালিয়াতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করার ১৫ দিনের ব্যবধানে এখন প্রধান কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। ব্যাংকটির লোকাল শাখার শীর্ষ সব কর্মকর্তা প্রায় ১৫ বছর ধরে একই পদে চাকরি করছেন। অথচ ব্যাংকিং আইন অনুসারে তিন বছরের বেশি কোথাও থাকার সুযোগ নেই। ব্যাংকিং অনিয়মের শাস্তি না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বর্তমানে তদবিরের ভয়াবহ চাপে রয়েছে ব্যাংকিং খাত। তদবির ছাড়া ব্যাংকে এখন আর কোনো নিয়োগই হয় না। ব্যাংকের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের আরেক ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সাবেক কর্মকর্তাদের মতো দুর্নীতিপরায়ণ কাউকে নিয়োগ দিলে তারা ভালো ব্যাংককেও শেষ করে দেবে। সরকারি ব্যাংকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পয়সা চুরি করে সাধারণ মানুষের করের টাকা দিয়ে মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হয়। অথচ এসব কর্মকর্তার শাস্তি হয় না। এটা আমাদের পুরো ব্যাংকব্যবস্থাকে সংকটের মধ্যে ফেলেছে।

সর্বশেষ খবর