রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই

জয়শ্রী ভাদুড়ী

গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই

বাসে ওঠার প্রতিযোগিতা। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা মেলে এ চিত্র —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর নর্দা বাজার থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার না হলেও এর জন্য যাত্রীদের গুনতে হয় ২৫ টাকা ভাড়া। মিরপুরের কালশী সড়কের মাটিকাটা অংশে ইসিবি চত্বর থেকে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের দূরত্ব মাত্র ১ কিলোমিটার। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই পথটুকুর সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়ার কথা ৫ টাকা। অথচ গণপরিবহনগুলো এর ভাড়া আদায় করছে ২৫ টাকা। সিটিং সার্ভিসের নামে এভাবেই যাত্রীদের কাছ থেকে গলা কাটা ভাড়া আদায় করছে গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা। এর মধ্যে তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ল সিটিং সার্ভিসের। ঈদুল আজহার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে সিটিং সার্ভিসসহ সুষ্ঠু যাত্রীসেবা কমিটি। বিআরটিএর পরিচালক শেখ মাহবুব ই রব্বানীকে প্রধান করে বিভিন্ন পেশাজীবীর সমন্বয়ে আট সদস্যের এ কমিটি গঠিত। গত বৃহস্পতিবার কমিটির সভায় গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং সিটিং সার্ভিস ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে ১০টি সুপারিশ করেছে এই কমিটি। কমিটির সদস্য সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী ঈদ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সিটিং সার্ভিসের। তবে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নির্ধারণসহ গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে— সিটিং ও নন সিটিং গাড়ির রং আলাদা করা হবে। মানুষ যেন দূর থেকে দেখলেই বুঝতে পারে গাড়ি সিটিং কিনা। এর সঙ্গে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া এবং রুট নির্ধারণ করে দেওয়া  হবে। গণপরিবহনের মালিকানা থাকবে চার-পাঁচটি কোম্পানির হাতে। ফলে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো এবং গাদাগাদি করে যাত্রী তোলার দৌরাত্ম্য কমবে। সিটিং সার্ভিসের স্টপেজ আলাদা থাকবে। নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা করানো যাবে না। এর সঙ্গে ট্রাভেল কার্ডের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে করে যাত্রী কার্ড রিচার্জ করে বাসে যাতায়াত করতে পারবেন। গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগাতে হবে। এতে কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে বা কোনো অপরাধ করলে তাদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা যাবে। পথচারী পারাপারে রোডে জেব্রাক্রসিং থাকবে। এ ছাড়া নতুন কিছু ডাবল ডেকার বাস নামানোর সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে কম গাড়িতে বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে। এর পাশাপাশি প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা কমাতে মানুষকে গণপরিবহনে যাতায়াত করতে উৎসাহিত করা হবে। গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সিটিং সার্ভিস বন্ধের নির্দেশনা দিলে বাস মালিক-শ্রমিকরা রাস্তায় বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেয়। পরবর্তীতে সিটিং সার্ভিস চলাচলের অনুমতি দিয়ে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সিটিং সার্ভিস বিষয়ে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। গত জুলাই মাসে মেয়াদ পার হলেও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি কমিটি। পরবর্তীতে আরও দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ বেড়ে ঈদের পরে গিয়ে পৌঁছেছে আর এর সঙ্গে বাড়ছে সিটিং সার্ভিসের মেয়াদও। গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে যাত্রী আর বাসের সুপারভাইজারদের বাকবিতণ্ডা প্রতিদিনের চিত্র। মাঝে মাঝে তা পৌঁছে যায় হাতাহাতি পর্যায়ে। গতকাল সকালে রাজধানীর বিমানবন্দর স্টেশন থেকে কুড়িল বিশ্বরোডে যাওয়ার জন্য ‘সুপ্রভাত স্পেশাল সার্ভিস’ এ ওঠেন ফয়েজ রহমান। বাসে ওঠার পরই তার কাছে ভাড়া চান সুপারভাইজার। তিনি ১০ টাকা দিলে সুপারভাইজার দাবি করেন ১৫ টাকা। এ নিয়ে শুরু হয় কথা কাটাকাটি। একপর্যায়ে তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে খিলক্ষেতের আগে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নামিয়ে দেয় গাড়ির সুপারভাইজার এবং হেলপার। গাড়ির অপর যাত্রী মিজান উদ্দিন বলেন, প্রতিদিনই গাড়িতে যাত্রীদের সঙ্গে বাসের হেলপার-সুপারভাইজাররা খারাপ ব্যবহার করে। এরা বিভিন্ন দিন বিভিন্ন রকম ভাড়া চায়। না দিলেই সিটিং সার্ভিস নাম নিয়ে চলে এদের বাটপারি। কাজে যাওয়ার সময় এদের এই ব্যবহারে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে যাতায়াতের জন্য রুট আছে ১২২টি। ১১৬ দশমিক ৮ বর্গমাইল আয়তনের রাজধানীতে বাস করে প্রায় দুই কোটি মানুষ। আর মানুষের যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন আছে প্রায় পাঁচ হাজার। তাই জনসংখ্যার তুলনায় রুট ও গণপরিবহন কম থাকায় প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়ছে লাখো মানুষ। সাধারণ মানুষের এসব ভোগান্তির সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন গণপরিবহন কোম্পানি। এ বছরের জুনে সিটিং সার্ভিস বিষয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে ৮৮ শতাংশ গাড়ি চলাচল করছে সিটিং সার্ভিস লোগো লাগিয়ে। এগুলোতে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। নির্ধারিত স্টপেজ বাদ দিয়ে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা চলছে। এ ব্যাপারে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই সিটিং সার্ভিসের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ এবং সেবার মান বাড়াতে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু দফায় দফায় সিটিং সার্ভিসের মেয়াদ বাড়লেও যাত্রীদের দুর্ভোগ কমছে না। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না আনলে রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান কখনই হবে না বরং প্রতিদিন আরও বাড়ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর