রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাড়ে ২১ হাজার রাজস্ব মামলা দেখার কেউ নেই

আটকে আছে ১৯ হাজার কোটি টাকা শীর্ষে কাস্টমস

রুহুল আমিন রাসেল

দেশের উচ্চ আদালতে এখন রাজস্ব মামলা সাড়ে ২১ হাজার। তাতে আটকে আছে সরকারের ১৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। ১০ মাস যাবৎ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) নেই কোনো আইন কর্মকর্তা। ফলে ব্যাপক এই মামলা দেখার যেন কেউ নেই। রাজস্ব মামলা নিষ্পত্তিতে প্রশাসনের গা ছাড়া ভাবে হতাশ করদাতারা। জানা গেছে, দেশের উচ্চ আদালতে বছরের পর বছর ঝুলে থাকা রাজস্ব মামলা সমন্বয়ের অভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ফলে      বাড়ছে দীর্ঘসূত্রতা। এতে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এনবিআরের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত জুলাই পর্যন্ত দেশে সর্বমোট ২১ হাজার ৪৪৪টি রাজস্ব মামলা উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে। এসব মামলার বিপরীতে সরকারের পাওনা ১৯ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা কাস্টমসের। বর্তমানে ১১ হাজার ৮৮৭টি মামলাই কাস্টমস-সংক্রান্ত। এর পরই আছে ৬ হাজার ২৩টি আয়কর ও ৩ হাজার ৫০৪টি মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটসংক্রান্ত মামলা। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এনবিআরের ট্রাইব্যুনালে কর্মকর্তারা বিচারক হওয়াতেই রাজস্ব মামলা বাড়ছে। আবার কর্মকর্তাদের অসতর্কতা ও ইচ্ছাকৃত নানাবিধ কারণেও মামলা হচ্ছে বা বাড়ছে। তবে মামলার ক্লাসিফিকেশন করে জট কমানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একটা মামলা সমাধান হলে, কয়েক শ মামলা নিষ্পত্তি হবে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মামলাজট থেকে বের হতে চান। কিন্তু এনবিআর মামলার জট খুলতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) আজও কার্যকর করতে পারেনি। কর ন্যায়পালও কার্যকর নেই। আমরা মনে করি, মামলার জট বন্ধে কাস্টমস আইন যুগোপযোগী করতে হবে। এর সঙ্গে সব অংশীজনের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান দরকার।’

জানা গেছে, দেশের উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা রাজস্ব মামলার কারণে সরকার যেমন বিপুল পরিমাণে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঝুলে থাকা রাজস্ব মামলার অধিকাংশের ব্যাংক গ্যারান্টি ও নথি ব্যবস্থাপনাও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতে চলমান রাজস্ব মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণ সমন্বয়ের অভাব। তবে আদালতের সঙ্গে এনবিআরের অধীন দফতরগুলোর যথাযথ সময়ানুগ সংযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। এর আগে ২০১৫ সালে জটবদ্ধ রাজস্ব আদায় ও মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রাধিকার ভিত্তিতে ৮টি পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেলকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এনবিআরের পক্ষ থেকে ওই চিঠিতে ‘করণীয়’ বলা হয়— অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদত্ত হাই কোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ‘অধিক রাজস্ব জড়িত’ রিট মামলাগুলোকে কজলিস্টভুক্ত করে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ। এনালোগাস ও অনিষ্পন্ন কয়েক হাজার মামলার তালিকা করে ডেপুটি সলিসিটরদের (রিট) কাছে পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্টদের নিবিড়ভাবে সম্পৃক্তকরণ। আদালতে মামলার সূচনালগ্নে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞদের সঙ্গে কাস্টমসের একজন প্রতিনিধির অবস্থান ও বক্তব্য প্রদান নিশ্চিতকরণ। বিচারকদের কাস্টমসের প্রায়োগিক, আইনি, কারিগরি সম্পর্কে তাত্ক্ষণিক অবহিত করা গেলে ‘প্রিম্যাচুরড মামলা’ উপেক্ষিত হবে। এতে মামলা দায়েরের প্রবণতা কমবে। মেরিটহীন মামলা সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ সীমিত হবে। হাই কোর্ট বিভাগে সরকার পরাজিত মামলায় আপিল দায়ের ও এনবিআরের মামলা মনিটরিংয়ের জন্য একাধিক অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড (এওআর) নিয়োগ ও নির্দিষ্টকরণ। কেননা যথাসময়ে আপিল দায়ের না হলে নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলে প্রতিপক্ষ মামলায় কনটেম্পটের উদ্যোগ নেয়। কাস্টমস ও ভ্যাটের মামলা বিচারের লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের জন্য একই প্রকৃতির মামলার জন্য এক বা একাধিক পৃথক আদালতে ন্যস্ত রাখা। কেননা আদালত পরিবর্তন হলে পিটিশনাররা বিজ্ঞ আদালতকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নিয়ে রায় নিজেদের পক্ষে নেন। এনবিআরের মামলার জন্য নির্দিষ্ট ৬টি বেঞ্জের প্রতিটির জন্য অন্তত একজন সার্বক্ষণিক নিয়োজিতকরণ, যাতে একজন ছুটিতে বা অন্যত্র ব্যস্ত থাকলে অন্যজন শুনানিতে উপস্থিত থাকতে পারেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বেঞ্চ থেকে রায় ঘোষিত ও ঘোষিতব্য মামলার রায়ের সার্টিফায়েড কপি উত্তোলন ও এ-সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য একজনকে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা। ওই পত্রে আরও হয়, বিরাজমান মামলার জট খুলে দিতে প্রাইভেট রিটেইনারের দরকার হবে না। পাশাপাশি উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারলে মামলাজট কমবে। মামলা দায়েরের প্রবণতা কমবে। রিট মামলা দায়েরর ক্রমবর্ধমানতা রোধ হবে। মামলাজটে আটকে থাকা রাজস্বের একটা বৃহদাংশ স্বল্পতম সময়ে আদায় সম্ভব হবে।

সর্বশেষ খবর