শিরোনাম
রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিন্ডিকেট বাণিজ্যের কবলে হজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

হজ নিয়ে রাঘববোয়ালদের বেপরোয়া বাণিজ্য চলছেই। এক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ফলে হজযাত্রীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তা বেড়েই চলছে।

ই-ভিসা জটিলতা, ফ্লাইট বিপর্যয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা, মধ্যস্বত্বভোগীর প্রতারণা এবং এক শ্রেণির মুনাফালোভী হজ এজেন্টদের চক্রে পড়ে হজযাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। এই সংকটের জন্য হজ এজেন্সি এবং ধর্ম মন্ত্রণালয় পরস্পরকে দোষারোপ করছে। প্রায় প্রতিদিনই যাত্রীর অভাবে বাতিল হচ্ছে শিডিউল ফ্লাইট। ই-ভিসা জটিলতার কারণে টিকিট কনফার্ম থাকার পরও যাত্রীরা বিমানে উঠতে পারছেন না। ফলে প্রায় ৩০ হাজার যাত্রীর হজ করা ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

হজযাত্রার উদ্দেশে টাকা জমাদানের পরপরই মক্কায় থাকার জায়গা নির্ধারণ, ভিসা সংগ্রহ ও সব শেষে এয়ারলাইনসের টিকিট প্রাপ্তি— প্রতি ধাপেই চলে সীমাহীন সিন্ডিকেটবাজি। প্রতি ঘাটেই থাকে এজেন্সি মালিক ও দালালদের মাত্রাতিরিক্ত দৌরাত্ম্য। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, হজের উদ্দেশে সরকারি ফি জমাদানের সঙ্গে সঙ্গেই মক্কায় বাড়ি ভাড়া নিশ্চিত করার জন্য এজেন্সিগুলোর চাহিদা মাফিক টাকাও জমা দেওয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট এজেন্সির দালালরা বাড়ি ভাড়া বাবদ কয়েকগুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিতে নানা ফন্দিফিকির চালায়। তাদের ধান্দাবাজি আর গাফিলতির কারণেই বিলম্বে অতিরিক্ত দামে যেমন নিম্নমানের বাড়ি ভাড়া করতে হয়, তেমনি বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্রের কপি পেতেও দীর্ঘ বিলম্ব ঘটে।

হাজীদের বিমানের টিকিট নিয়েও ফি বছর চলে রমরমা সিন্ডিকেট বাণিজ্য। আর এই সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নির্ধারিত টিকিটের মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি টাকা গুনেন হজ করতে ইচ্ছুক ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। হজযাত্রী পরিবহনে ট্রাভেল মালিকদের থার্ড ক্যারিয়ার চালু (সব বিমান উন্মুক্ত) করার দীর্ঘ দিনের দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় সিন্ডিকেট ব্যবসা জোরদার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ট্রাভেল এজেন্সির মালিকরা। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ ও সৌদি এয়ারলাইনসই কেবল হজযাত্রীদের বহন করে থাকে। সৌদি এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে টিকিটপ্রতি এক লাখ ১৬ হাজার ৯০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করলেও এজেন্সিগুলো টিকিটপ্রতি এক লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়। আবার সিন্ডিকেট বাণিজ্যের হোতারা এ দুটি এয়ারলাইনসের বিপুল পরিমাণ টিকিট আগাম কিনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং মোক্ষম সময়ে এসব টিকিট দেড়-দুইগুণ দামে বিক্রি করে থাকে।

হাবের বর্তমান কমিটির শীর্ষ এক নেতা সৌদি এয়ারের অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও ঝামেলায় পড়ার ভয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ করছে না। ভুক্তভোগীদের মতে, সৌদি এয়ারের ঢাকা অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা টিকিট বিক্রির এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তারা দায়িত্ব দেওয়া সাতটি এজেন্সি থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ এবং অন্যান্য সুবিধা নিয়ে এ কাজটি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাবের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল কবির খান জামান বলেন, ‘সৌদি এয়ারের টিকিটে বাড়তি টাকা নেওয়ার কথা আমরাও শুনছি। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ না করলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না।’ থার্ড ক্যারিয়ার না থাকায় এ ধরনের অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সরকারের জারি করা বিশাল হজ প্যাকেজের পরিণতিতে ২৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে ৫ হাজারের বেশি হজযাত্রীকে। সংশ্লিষ্ট অনেকেই এখন এ জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ আনছে। চলতি বছর সময়মতো ভিসার আবেদন করতে পারেনি এমন ২৮টি হজ এজেন্সিকে ভিসার আবেদন করতে দুই দিনের আলটিমেটাম বেঁধে দেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। তিনি বলেছেন, এ সময়ের মধ্যে ব্যর্থ এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হবে। সম্প্রতি আশকোনা হজক্যাম্পে হজের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান তিনি। হজ ফ্লাইট বাতিলসহ ভিসা জটিলতার জন্য হজ এজেন্সিগুলোকে দায়ী করেন মন্ত্রী।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রাপ্ত পরিসখ্যান অনুযায়ী মোট ২৮টি এজেন্সি ৫ হাজার ১১৭ জন হজযাত্রীর ভিসার আবেদন জমা দেয়নি। ভিসা জটিলতায় যাত্রীশূন্য পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিদিনই একাধিক হজ ফ্লাইট বাতিল করার ঘটনা ঘটছে। তবে এ দায় নিতে নারাজ এজেন্সিগুলো। হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মহাসচিব শাহাদাত হোসেন তসলিম বলেন, ভিসার বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া এবং এটা সৌদি সরকারের ওপর নির্ভর করে। তবে এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আগামী ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ভিসার প্রক্রিয়া চলবে। এ সময়ের মধ্যে আশা করি সব সমস্যা কেটে যাবে। সবার ভিসা সম্পন্ন হবে এবং সবাই হজে যেতে পারবেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হাফিজ উদ্দিন বলেন, ভিসা জটিলতা নিরসনে কাজ চলছে। আমাদের হাতে এখনো সময় আছে। কাজেই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আশা করছি, সময়মতো সব সমস্যা কেটে যাবে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, মুয়াল্লিম ফি বৃদ্ধি, ই-ভিসা জটিলতাসহ নানা কারণে এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৮৫৩ জন এবার হজে যেতে পারেননি। মন্ত্রী বলেন, ‘সৌদি সরকার এবার মুয়াল্লিম ফি বাড়িয়েছে ১ হাজার ৫০০ রিয়াল। এসব জটিলতা নিরসনে সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে।’

সর্বশেষ খবর