মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভারতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্বের যত কারণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে পারেনি বিএনপি। দলটিতে ভারতবিরোধী নেতাদের আধিপত্য এবং ক্ষমতার গত মেয়াদে নেওয়া কিছু হঠকারী সিদ্ধান্ত পার্শ্ববর্তী এই দেশটির সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। যদিও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভারতের সঙ্গে একটা ইতিবাচক সম্পর্কের সূচনা করে যান। দলীয় নেতাদের মতে, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সুসম্পর্কের ভিত্তিতেই সে সময় সীমান্তে কাদেরিয়া বাহিনীর তৎপরতা বন্ধ হয়। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পরও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ ছিল না। ১৯৯৬ সালে বিএনপি বিরোধী দলে গেলে বরং ভারতের সঙ্গে দলটির সম্পর্কের আরও উন্নতি ঘটে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া আবার ক্ষমতায় এলে তৎকালীন বিজেপি সরকারের সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্ক ছিল ইতিবাচক। এর পরের এক-দুই বছরের মধ্যেই এ সম্পর্ক অবনতির দিকে যেতে থাকে। অনেকের মতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের চির ধরে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর সিইউএফএল জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের অবনতির জন্য যেসব কারণ আছে বলে মনে করেন, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে চট্টগ্রামের এই দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার। ভারত মনে করে, ওইসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমুদ্রপথে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘উলফা’র জন্য আনা হয়েছিল। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী উৎপাত বন্ধে তৎকালীন বিএনপি সরকারের অসহযোগিতা, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র সঙ্গে গোপন যোগাযোগ, জামায়াতসহ কট্টরপন্থি দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির জোট, যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে অস্পষ্টতা ও তাদের সন্তানদের দলের নেতৃত্ব রাখা, দলীয় বুদ্ধিজীবীদের ভারতবিরোধিতা এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্ধারিত সাক্ষাতে না যাওয়ায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ফাটলের প্রধান কারণই ছিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা। চীনে তৈরি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘উলফা’র জন্য আনা হয়েছিল বলে বাংলাদেশের আদালতেও প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল অস্ত্রের এই চালান। এ ঘটনায় তৎকালীন বিএনপির সরকারের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয় ভারত সরকার। এরপর থেকেই বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই অবনতি ঘটতে থাকে। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগে একটি এবং ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনে অন্য আরেকটি মামলা হয়। পাঁচ দফা তদন্ত কর্মকর্তা বদল এবং তিন বছরেরও বেশি সময় শুনানির পর ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি এ মামলা রায় হয়। রায়ে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপি নেতা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। নিজামী-বাবর ছাড়াও দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের তৎকালীন (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রহীম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপ-পরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, ভারতীয় বিছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন, অস্ত্র বহনকারী ট্রলারের মালিক হাজী সোবহান, চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান ও অস্ত্র খালাসের শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ। বিএনপি সূত্র জানায়, দলের একটি পক্ষ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করলেও ভারতবিরোধী নেতাদের কারণে তা আর বেশিদূর এগোয়নি। দলটিতে এখনো ভারতবিরোধী মনোভাব যথেষ্ট। দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষের নেতাদের মতে, ভারত পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী একটি দেশ। স্বাভাবিক কারণেই এ দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর