চিকিৎসায় গাফিলতি, অহেতুক বিল বাড়িয়ে দেখানো, অকারণে ব্যয়বহুল পরীক্ষা, এক ওষুধ বার বার দেওয়া, রুপি পরিশোধ না করলে লাশ আটকে রাখা— এমন একের পর এক অভিযোগ উঠে আসছে কলকাতা শহরের নামি বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোর বিরুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গের এই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা করতে আসা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদেশি বিশেষ করে বাংলাদেশি রোগীদেরও প্রতিনিয়ত এই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। স্বাভাবিকভাবেই এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। হাসপাতালগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে রোগীরা। গত কয়েক মাসে কলকাতার ছয়টি সেরা বেসরকারি হাসপাতালে বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বলে খবর। এর মধ্যে কয়েকটিতে রোগীর সংখ্যা কমেছে ১৫ শতাংশ। গত কয়েক দশক ধরেই শহরের ইএমবাইপাশ সংলগ্ন বেশ কয়েকটি হাসপাতালের ব্যবসায়িক দিকটি নির্ভর ছিল বাংলাদেশি রোগীর ওপর। বাংলাদেশ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও ভারতের অন্য রাজ্য থেকেও রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে এই হাসপাতালগুলোতে। কিন্তু ‘সেবার তুলনায় ব্যবসায়িক স্বার্থ’ বেশি দেখা হচ্ছে— এই অভিযোগ ওঠার পর থেকে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই এই অভিযোগের বিষয়টি সামনে এনে তাদের হুঁশিয়ারি দেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। অভিযুুক্ত হাসপাতালগুলোকে তোপ দেগে সে সময় মমতা নিজেই জানিয়েছিলেন যে, ‘সেবা করুন, সেবা কখনো বিক্রি হয় না। ইট কাঠের ব্যবসা চালানো আর মানুষের জীবন বাঁচানো এক জিনিস নয়, দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে। একশ শতাংশ লাভ করা যাবে না’। হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলোকে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখতে ‘হেলথ রেগুলেটারি কমিশন’ও গঠন করে রাজ্য সরকার। তবে এর পরও যে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। কলকাতা শহরের নামি একটি হাসপাতাল এএমআরআই বা আমরি। ঢাকুরিয়া, মুকুন্দপুর ও সল্টলেক-আমরির এই তিনটি কেন্দ্রেই প্রতিমাসে গড়ে ২৫০০ বাংলাদেশি রোগী আসে। কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে এই সংখ্যাটা প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে। আমরির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) রূপক বড়ুয়ার অভিমত গত ফেব্রুয়ারিতে আমরিতে রোগীর পরিবারের তরফে হামলার পরই কলকাতার হাসপাতালগুলোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। রূপক বড়ুয়া জানান, ‘এরপর থেকেই কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমতে থাকে। কলকাতার পরিবর্তে তাদের এখন প্রথম পছন্দ দিল্লি এবং দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো। স্বাস্থ্য পরিষেবাটি মূলত বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কিন্তু একবার যদি সেই বিশ্বাসে ভাঙন ধরে তবে এই শিল্পের পক্ষে তা বিপজ্জনক’। কলকাতার ইএমবাইপাশের ধারেই রয়েছে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল রুবি জেনারেল হাসপাতাল। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪৫০ বাংলাদেশি রোগী আসে এখানে। এরমধ্যে ইনডোর পেসেন্টের সংখ্যা ৩০ জনের মতো, গত জুনে সেই সংখ্যাটা নেমে ২০-এ দাঁড়ায়। রুবির জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাডমিন) শুভাশিস চক্রবর্তী জানান, ‘গত মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত আন্তঃবিভাগ এবং বহিঃবিভাগে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা অনেকটা কমেছে। জুলাইতে সংখ্যাটা একটু বাড়লেও ভারতের অন্য শহরগুলোতে বাংলাদেশি রোগীদের চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাটা পড়েনি’। তিনি আরও জানান, ‘গত ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠার পর থেকে বাংলাদেশি রোগীরা এই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছিলেন এবং সোস্যাল মিডিয়াতেও বিভিন্ন মতবিনিময় করছিলেন। তারা এখন আমাদের হাসপাতালগুলোর ওপর খুবই সতর্ক, বিশেষ করে হাসপাতালগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে। রোগীর সংখ্যা খুব বেশি হারে না কমলেও অচলাবস্থা এখনো জারি রয়েছে।
তবে বাংলাদেশি রোগীর হ্রাসের পেছনে ভিসা সমস্যাও কাজ করেছে বলে অভিমত শুভাশীষ চক্রবর্তীর। তিনি জানান, ‘কলকাতার হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রোগীদের মেডিকেল ভিসা করাটা এখন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেছে যে, তারা মূলত ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে কলকাতায় বেড়াতে এসে চিকিৎসা করাতে বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু এখন তাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে ভাবমূর্তি ভালো যেমন চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এবং দিল্লির মতো শহরগুলোকে বেছে নিতে পারছে। দক্ষিণ কলকাতার দুটি বেসরকারি হাসপাতালেও বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমেছে। প্রতি মাসে গড়ে এই হাসপাতাল দুটিতে যেখানে ৭০০ রোগী আসত সেখানে গত পাঁচ মাসে কমেছে ৫ শতাংশ। তবে এতকিছুর মধ্যে কলকাতার কয়েকটি হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা অল্প হলেও বেড়েছে বলে খবর। এর মধ্যে একটি হলো ইএম বাইপাশের ধারে অবস্থিত অ্যাপোলো গ্লেনিগেলস হাসপাতাল। এই হাসপাতালটিতে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৬,৫০০ রোগী আসে। মুকুন্দপুরের রবীন্দ্র নাথ টেগোর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেস (দেবি শেঠি বলে সর্বাধিক পরিচিত) হাসপাতালেও বাংলাদেশি ও ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতে আসা রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর।