রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তা

সাখাওয়াত কাওসার

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী জঙ্গি অবস্থানের পর অতিমাত্রায় সতর্ক সব কটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কেবল এ বিষয়টি নিয়েই বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠকে বসছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট সিরিজের নিরাপত্তায় কোনো ধরনের দুর্বলতা না রাখতেই এসব বৈঠক। এর বাইরে পবিত্র ঈদুল আজহা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস ঘিরেও সাজানো হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা-বলয়। কেবল রাজধানী নয়, সারা দেশেই বিস্তৃত হয়েছে এই নিরাপত্তা জাল। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট সিরিজের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতে থাকছে সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডোরা। এরই মধ্যে প্যারাকমান্ডোরা মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে তাদের মহড়াও করেছে। আগামী সেপ্টেম্বরে শারদীয় দুর্গাপূজা পর্যন্ত এই বাড়তি নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। ১৬ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে পুলিশপ্রধান এ কে এম শহীদুল হক উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদুল আজহা উদ্যাপনে নিষ্ঠা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়া মহাসড়কে কোরবানির পশুবাহী ট্রাক না থামাতে এবং সড়ক, রেল, নৌপথ, পশুরহাট ও ঈদ জামাতস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আগস্ট মাস এলেই আমরা বাড়তি সতর্ক হই। এ মাসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। সিরিজ বোমা হামলা চালানো হয়েছে। সব ধরনের আশঙ্কাকেই আমরা সিরিয়াসলি নিচ্ছি এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’

ক্রিকেট সিরিজ ও অনুশীলন ম্যাচের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও বিসিবি প্রতিনিধিদের মধ্যে এক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দফতরে।

বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে আলোচনা হয় সমন্বয়ের বিষয়টি। গতকাল ডিএমপির বিশেষায়িত দল সোয়াতের মহড়া শেষে সাংবাদিকদের ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, হোটেল থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত ভিভিআইপি নিরাপত্তা পাবেন খেলোয়াড়রা। দুই ম্যাচ সিরিজের পুরো সময় জুড়ে টিম অস্ট্রেলিয়া তিন স্তরের ভিভিআইপি নিরাপত্তা পাবে। কমিশনার বলেন, খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার জন্য হোটেল রেডিসনের চতুর্দিকে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। হোটেল রেডিসন থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত খেলোয়াড়দের ভিভিআইপিদের মতো নিরাপত্তা দেওয়া হবে। সে জন্য পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স টহল সর্বদা থাকবে। খেলোয়াড়দের জন্য স্টেডিয়াম ও হোটেল এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে। স্টেডিয়ামের ভেতরে ও বাইরে তিন স্তরের নিরাপত্তা রাখা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার বলেন, পুলিশ-বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড), ডিবি (মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা) ও অন্যান্য বাহিনী মিলে নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুরো স্টেডিয়াম এলাকা সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়া মাঠ ও গ্যালারিকেন্দ্রিক নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। খেলোয়াড়রা যখন হোটেল রেডিসন থেকে স্টেডিয়ামে আসবেন, তখন মিরপুর ১০ নম্বর থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত ভাসমান দোকান তুলে দেওয়া হবে। আর স্থায়ী দোকানগুলো ওই সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হবে।’ খেলা দেখতে আসা দর্শকদের গেটে গেটে তল্লাশি করা হবে জানিয়ে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘ধারালো চাকু-কাঁচি, ম্যাচ, ব্যাগ, ট্রলিব্যাগ, চায়ের ফ্ল্যাস্ক নিয়ে স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না। একটি দুষ্টচক্র, যারা বাংলাদেশের ভালো চায় না, যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র চায় না, তারাই নানা রকম অপচেষ্টা করতে পারে—এটি মাথায় রেখেই আমাদের পুরো নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে।’ জানা গেছে, খেলোয়াড় ও বিদেশি অতিথিদের আবাসনস্থল ও যাওয়া-আসার রাস্তার নিরাপত্তাব্যবস্থা, রুফটপ ডিউটি, মোবাইল ডিউটি, আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করে দর্শনার্থীদের স্টেডিয়ামে প্রবেশ করানো, খেলোয়াড়দের যাতায়াতের রাস্তা যানজটমুক্ত রাখা, ভেন্যু ও হোটেলকেন্দ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গোপনীয়) মনিরুজ্জামান বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া দলের বাংলাদেশে খেলতে আসা উপলক্ষে আমরা ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তাদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়া আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস, এ ক্ষেত্রে আমরা সফল হব। এর বাইরে ঈদুল আজহা, ২১ আগস্ট এবং শারদীয় দুর্গাপূজাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইজিপি সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এবারের নিরাপত্তায় জনবল বৃদ্ধির চেয়ে প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখেই নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তা ছক জানার পর সন্তোষ প্রকাশ করেছে টিম অস্ট্রেলিয়া ও বিসিবির (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্টরা। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা বিশ্বকাপ ক্রিকেট, এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টিরর মতো বড় বড় আসর সফলভাবে আয়োজন করেছি। টিম অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তায় আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। হোটেল, খেলার ভেন্যু নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষায় জিপিএস পদ্ধতি, ভেহিকেল ট্র্যাকিং স্ক্যানার, ডগ স্কোয়াড, ভেন্যু অপারেশন কমান্ড স্থাপনসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। ঈদুল আজহা এবং আগামী মাসে দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিয়ে এরই মধ্যে ব্যাটালিয়নের সিওদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ ক্রিকেট টিমের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘দেড় মাস আগে অস্ট্রেলিয়া দলের সিকিউরিটি ম্যানেজার আমাদের সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেছেন। তাদের প্রত্যাশার বাইরেও আমরা অনেক কিছু করেছি। হোটেলে বসেই যেন সার্বক্ষণিক সবকিছু মনিটর করা যায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে করে টিম কোথায় যাচ্ছে সেটিও মনিটর করা যাবে। খেলোয়াড়রা যেখানে থাকবেন সেই স্থান পুরো নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হবে।’ জানা গেছে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপন ও সর্বস্তরের মানুষের নিরাপত্তায় দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেড় লাখ সদস্য মোতায়েন থাকবে। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকায় দায়িত্ব পালন করবেন ১২ হাজার পুলিশ সদস্য। সঙ্গে থাকবেন এলিট ফোর্স র‌্যাব সদস্যরা। সাদাপোশাকে র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা ঘুরে বেড়াবেন। রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ ময়দান ও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে অনুষ্ঠেয় ঈদের জামাত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করা হবে। জাল টাকা ঠেকাতে, চাঁদাবাজি প্রতিরোধে, কাঁচা চামড়া পাচার বন্ধ, ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কোনো ধরনের ছাড় না দিতে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘরমুখো মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হাইওয়ে পুলিশ, নৌপুলিশ ও রেলওয়ে পুলিশকে সদর দফতর থেকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। রাজধানী থেকে চামড়া পাচার ঠেকাতে বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হচ্ছে চেকপোস্ট। ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, সব ধরনের আশঙ্কা আমলে নিয়েই আসছে কোরবানির ঈদ এবং ২১ আগস্টের নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। অতীতের মতো রাজধানীবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঈদের জাল টাকা ব্যবসায়ী এবং অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের তৎপরতা রোধে একাধিক টিম কাজ করছে। এরই মধ্যে সফলতাও এসেছে।

সর্বশেষ খবর