সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

এখনো ভাঙছে বাঁধ ডুবছে জনপদ

প্রতিদিন ডেস্ক

এখনো ভাঙছে বাঁধ ডুবছে জনপদ

গাইবান্ধার দাড়িয়াপুরে গতকাল স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

কোনো কোনো নদ-নদীর পানিতে জনপদ প্লাবিত হওয়া বা প্রতিরক্ষা বাঁধ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটলেও দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ধীরে উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে। দুর্গত মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সরকারও এ ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

বন্যাকবলিত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, টাঙ্গাইল, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ, জয়পুরহাট, রংপুর, নওগাঁ, সিলেট,  মৌলভীবাজার,  রাজবাড়ী, শেরপুর ও হবিগঞ্জ। বন্যার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন স্থান থেকে পাঠানো আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি ও প্রতিবেদকদের খবর— গাইবান্ধা : নদ-নদীগুলোর পানি অব্যাহতভাবে কমতে থাকার মুখেও গতকাল ঘাঘট নদীর পানির চাপে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা-নলডাঙ্গা সড়কে ধস নেমেছে। প্রায় ২০ ফুট অংশ ধসে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। হুমকিতে রয়েছে নিকটবর্তী রেললাইন ও রেলসেতু। এদিকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে আমুরি বেগম (৯) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং করতোয়া নদীতে গোসল করতে গিয়ে পানিতে ডুবে মিনা খাতুন (৭) নামে এক শিশু নিখোঁজ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ২৪ ঘণ্টায় তিস্তামুখ ঘাটে ব্রহ্মপুত্রের পানি ২৬ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি শহর পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। করতোয়ার পানি ১ সেন্টিমিটার কমে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাখালী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নওগাঁ : আত্রাই নদীর পানি কমে গিয়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ছোট যমুনা নদীর পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্তমানে এই নদীর পানি বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নওগাঁ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। সদরের ইকরতারা নামক স্থানে ছোট যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙে সদর উপজেলার তিলকপুর, বোয়ালিয়া ইউনিয়ন, নওগাঁ পৌরসভার পার-নওগাঁ, সুলতানপুর এলাকা, পার্শ্ববর্তী বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম, সান্তাহার এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। টাঙ্গাইল : পৌলী রেল সেতুর দক্ষিণ পার্শ্বের এপ্রোচের মাটি ধসে যাওয়া অংশে মেরামত কাজ চলছে। এ অবস্থায় রেল চলাচল ৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর ঢাকা-থেকে উত্তরবঙ্গের রেলযাত্রীদের বিকল্পভাবে পারাপার করানো হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রেল চলাচল স্বাভাবিক হবে বলে জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। প্রসঙ্গত, গতকাল টাঙ্গাইল পৌলী রেল সেতুর দক্ষিণ পাশের এপ্রোচের মাটি ধসে রেল লাইনের ২০/২৫টি গার্ডার নদীতে পড়ে যায়। সকাল ৬টার দিকে স্থানীয় লোকজন নদীতে গোসল করতে এসে এ অবস্থা দেখতে পেয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে জানান। এ সময়ই উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী নীল সাগর এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা যাচ্ছিল। স্থানীয় লোকজন লাল সালু কাপড় প্রদর্শন করে ট্রেনটি থামিয়ে দেন। এতে এটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। বেঁচে যান হাজার হাজার যাত্রীর প্রাণ।

লালমনিরহাট : স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তিস্তা ও সানিয়াজান নদীর পানির চাপে হাতীবান্ধা হাসপাতালের  পেছনে ২০০ মিটার রেলপথ ভেঙে যাওয়ায় ১০দিন ধরে বুড়িমারী স্থলবন্দরের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। হাতীবান্ধা ও কালীগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে ভেঙে যাওয়া ওই রেলপথটি মেরামত করতে সরকারের অপেক্ষায় না থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। গতকাল সকালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শত শত মানুষ নিজ বাড়ি থেকে বস্তা ও ট্রাকে করে মাটি এনে রেলপথ মেরামতের কাজ শুরু করেন। এতে নেতাদের মধ্যে অংশ নিয়েছেন হাতীবান্ধা উপজেলা চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন বাচ্চু, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ সরওয়ার হায়াত খান, টংভাঙ্গা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম হোসেন ও সির্ন্দুনা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নুরল আমিন। লালমনিরহাট রেল বিভাগের বিভাগীয় ম্যানেজার নাজমুল হাসান বলেন, ‘স্থানীয় লোকজন রেল বিভাগের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছেন, দেশের মানুষ তা কখনই ভুলতে পারবে না। স্থানীয় জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’ বগুড়া : পানি কমতে শুরু করলেও বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। বানভাসি মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ২৭ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখনো লোকালয় থেকে পানি নামা শুরু করেনি। ফলে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া বানভাসি মানুষের ঘরে ফেরার অবস্থা হয়নি। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমিন জানান, যমুনায় পানি কমতে শুরু করায় বাঁধের ঝুঁকি অনেকটা কমে গেছে।

নাটোর : সিংড়ায় আত্রাই নদীতে বিপদসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় সিংড়া-আত্রাই বাঁধ ভেঙে সড়কের ওপর দিয়ে উপচে পড়ছে পানি। এতে উপজেলার তাজপুর ইউনিয়নের ১০টি ও শেরকোল ইউনিয়নের ৫টি গ্রামসহ মোট ১৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয়রা বাঁধটিকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষায় বালির বস্তা ফেলছেন। নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার জানান, শনিবার রাতের পর থেকে আত্রাই নদীতে হঠাৎ করেই পানি বেড়ে যায়। উজান থেকে পানি নেমে আসার কারণে এখানে পানি বাড়ছে। তিনি বলেন, যমুনা নদীর পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। আশা করা যাচ্ছে দুই-একদিনের মধ্যে এই এলাকাতেও পানি কমে যাবে। পঞ্চগড় : পঞ্চগড়ে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও  দুর্গত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণের সংকট এখনো কাটেনি। অনেকের ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে আমনের ক্ষেত। মাছ চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। এ অবস্থায় এসব অসহায় মানুষ এখন ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মতো সহযোগিতা চাইছেন। জয়পুরহাট : আক্কেলপুর উপজেলার মোহনপুর নামক স্থানে বন্যায় ভেসে আসা ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্থানীয়দের খবর পেয়ে গতকাল সকালে পুলিশ ওই বৃদ্ধের মৃতদেহ উদ্ধার করে। আক্কেলপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সিরাজুল ইসলাম জানান, সকালে কৃষি কাজে মাঠে আসা কৃষকরা ওই বৃদ্ধের ভাসমান মৃতদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরা অবস্থায় মৃতদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে। উজান থেকে মৃতদেহটি ভেসে আসতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। শরীয়তপুর : পদ্মা পাড়ের আশপাশের ৪৫টি গ্রাম প্লাবিত অবস্থায় রয়েছে। এই সঙ্গে ভাঙনকবলিত হয়েছে পদ্মা পাড়ের কয়েক হাজার মানুষ। ঘরে মাচা পেতে থাকতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। এদিকে শরীয়তপুরের জাজিরা-নড়িয়ায় ২৬৫টি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। দুই উপজেলায় বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢোকায় দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ। কুষ্টিয়া : গড়াই নদীর তীব্র স্রোতে কুষ্টিয়া শহর রক্ষা বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। গতকাল দুটি পয়েন্টে বাঁধের প্রায় ৫০ মিটার বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, আপাতত এই ধসে আশঙ্কার কিছু না থাকলেও নদীতে আরও পানি বাড়লে হুমকির মুখে পড়তে পারে কুষ্টিয়া শহর। সরেজমিন দেখা গেছে, বাঁধের ব্লক ধসে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ হোসেন জানান, গড়াই নদীর ব্লক বাঁধের দুটি পয়েন্টে আনুমানিক ৫০ মিটার ধসে গেছে। নদীতে পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি স্রোত বেড়ে যাওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। এদিকে গতকাল কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে আরও ২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। জেলার ভেড়ামারা হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে পদ্মায় পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয় ১৩.৭৯ মিটার। বিপদ সীমা থেকে নদীর পানি প্রায় ৪৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গড়াই নদীতে পানি স্থিতি অবস্থায় আছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়। নারায়ণগঞ্জ : শীতলক্ষ্যা নদীসংলগ্ন এলাকায় চলছে পানির জোয়ার ভাটায় বন্যার আগমনী বার্তা।  প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে নদীর পানি। একটু একটু করে এখন এ নদীর পানি বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। এ নিয়ে জেলায় বিরাজ করছে বন্যা আতঙ্ক। গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদী বিপদসীমা ছাড়িয়ে ৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, পানি নেমে যাবে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দোহার (ঢাকা) : পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দোহারে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে। বিলাশপুরের মাঝিরচর, মধূরচর, রাধানগর, হাজার বিঘা, নারিশা জোয়ার, মাহমুদপুরের হরিচন্ডী, নারায়ণপুর, চর কুশাইর চর জামার চরসহ প্রায় ৩০টি গ্রাম এখন পানিতে ভাসছে। এতে প্রায় ৩০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। নিমজ্জিত হয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তলিয়ে গেছে কাঁচা-পাকা সড়ক ও ব্রিজ। কোথাও কোথাও আবার নদীর পাড়ে ভাঙন দেখা দেওয়ায় মানুষ আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছেন।

সর্বশেষ খবর