বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

লিবিয়ার বন্দীশালায় বাংলাদেশি ২৮ জন

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মহিষমারী গ্রামের দিনমজুর বিজ্ঞান সরকার। সংসারে সমৃদ্ধির আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে। একই উপজেলার জাহিদুল ইসলাম সহায়-সম্বল সব বিক্রি করে সুখের আশায় সেই টাকা তুলে দিয়েছিল দালালের হাতে। দালালরা তাদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায় লিবিয়ায়। সেখানে তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনের সেই চিত্র মুঠোফোনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখানো হয় তাদের স্বজনদের। দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। মুক্তিপণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে কিংবা দিতে না পারলে চালানো হয় আরও বেশি নির্যাতন। এভাবেই চক্রটি বিদেশে নিয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিত। এই চক্রের হাতে এখনো জিম্মি রয়েছেন মাদারীপুরের ২৮ জন। আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের এমনই এক সদস্যকে আটক করেছে মাদারীপুর র‌্যাব। আটকের পর বেরিয়ে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। র‌্যাব-৮-এর মাদারীপুর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রাকিব জানান, দীর্ঘদিন ধরে একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র ইতালি, স্পেন, গ্রিসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মোটা বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে মানব পাচার করে আসছে। এ চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ, লিবিয়া ও ইতালিতে সমভাবে সক্রিয় এবং এদের শিকার মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সের বেকার যুবক। চক্রটি বাংলাদেশ থেকে প্রাথমিকভাবে এই যুবকদের লিবিয়ায় পাচার করে থাকে। পরে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সদস্যরা সে দেশে বন্দীশালায় তাদের আটক রেখে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এবং বন্দীদের নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে। এ চক্রে জড়িত অভিযোগে ২১ আগস্ট শিবচরের দত্তপাড়া ইউনিয়নের ধুয়াটি গ্রাম থেকে সিরাজ মাতুব্বরকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি প্রাথমিকভাবে মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করেন। এ সময় তার কাছ থেকে মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত টাকা, ব্যাংকে জমার রসিদ, স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিনামাসহ দালিলিক প্রমাণাদিও উদ্ধার করে র‌্যাব। মেজর রাকিব বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি, লিবিয়া অংশের অন্যতম প্রধান মো. শহিদুল মাতুব্বর। চক্রটি লিবিয়াপ্রবাসী মো. শহিদুল মাতুব্বরের নেতৃত্বে সে দেশে বন্দীশালায় পাচার করা বাংলাদেশি যুবকদের অর্ধাহারে-অনাহারে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছে। আর সিরাজ মাতুব্বরসহ বাংলাদেশে অবস্থানরত সদস্যরা পাচারের শিকার যুবকদের নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে। তিনি বলেন, ‘৬ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২৮ যুবককে পাচার করে চক্রটি। এদের মধ্যে বর্তমানে আটজন শহিদুল মাতুব্বরের অধীনে লিবিয়ার বন্দীশালায় জিম্মি আছেন। এই আটজনকে লিবিয়া পাঠানোর সময় পাচার শহিদুল মাতুব্বর ৩৫ লাখ টাকা নেন। সেখানে পৌঁছার পর মুক্তিপণ বাবদ আসামি সিরাজ মাতুব্বর বিভিন্ন সময় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমন প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরও অনেক বেশি মুক্তিপণ আদায় করেছে চক্রটি।’ বিদেশে পাচারের শিকার লিটু মণ্ডলের মা ফণীমালা মণ্ডল বলেন, ‘আমার ছেলে মিস্ত্রির কাজ করত। সংসারে অভাব ছিল। সুখের আশায় দালালের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বিদেশ পাঠাই। তাকে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হতো। এরপর মোবাইলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই নির্যাতনের চিত্র দেখানো হতো আমাদের। পরে দাবি করা হয় মুক্তিপণ। টাকা না দিলে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হতো। এভাবে ১১ লাখ টাকা দিয়েছি দালাল চক্রের কাছে। এরপরও আরও টাকার জন্য আমার ছেলেকে জিম্মি করে রেখেছে তারা। আমি সরকারের কাছে আমার ছেলেকে উদ্ধারে সহযোগিতা চাই।’ মানব পাচারের শিকার বিজ্ঞান সরকারের মা রেবা সরকার বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। সংসারে সুখের আশায় ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বিদেশ থেকে অনেক টাকা পাঠাবে। সংসারের দুঃখ ঘুচে যাবে। কিন্তু উল্টো এখন জমিজমা বিক্রি করে এবং সুদের ওপর টাকা এনে দালালদের দিতে হচ্ছে।’ আরেক পাচারের শিকার পিন্টু মালোর ছোট ভাই ঝন্টু মালো বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মতো আরও অনেকেই লিবিয়ার বন্দীশালায় জিম্মি রয়েছে। সরকারের কাছে তাদের সবাইকে মুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।’ মাদারীপুর র‌্যাব-৮-এর কমান্ডার রাকিব জানান, জড়িতদের বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলার প্রস্তুতি চলছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পাচার চক্রটির অন্য সদস্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তদন্তের স্বার্থে অনেকের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর