সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

নূর সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ‘বাদল অ্যান্ড কোং’

রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ

নূর সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ‘বাদল অ্যান্ড কোং’

হাত বাড়ালেই টাকা। জোর খাটালেই টাকা। ধমক দিলেই টাকা। এত অল্পতে দেশের কোথাও টাকা কামানো না গেলেও সিদ্ধিরগঞ্জে তা সম্ভব। ব্যাপারটি সম্ভব করেছেন নূর হোসেন, যিনি নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডার মামলার প্রধান আসামি। ওই মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এখন তিনি কারাগারে বটে। কিন্তু তার সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন তারই আস্থাভাজনরাই। এদের শীর্ষে রয়েছেন তার ভাতিজা সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ও নাসিক ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার শাহজালাল বাদল। জনরবে শোনা যায়, ‘নূর হোসেন সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে বাদল অ্যান্ড কোং।’

খুন হওয়া সাতজনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল। এর পরই নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা গা ঢাকা দেয়। তারা দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকে। ওই সময় সাম্রাজ্যের অনেকখানিই হাতছাড়া হয়ে যায় নূরের। কিন্তু গত বছর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) নির্বাচনের আগে সক্রিয় হয়ে ওঠে তার সহযোগীরা। এরই মধ্যে হারানো নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই ফিরে গেছে তাদের হাতে। নাসিক নির্বাচনে পাঁচটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরও হয়েছে নূরের ঘনিষ্ঠরা। গত ১৬ জানুয়ারি নিম্ন আদালতে নূর হোসেন ছাড়াও তার ৯ সহযোগীর ফাঁসির আদেশ হয়। এতে সহযোগীরা কিছুটা থমকে যায়। তবে এখনো দখল-চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে অন্তত দুই ডজন সহযোগী। গত ২২ আগস্ট হাই কোর্টের রায়ে ৯ সহযোগীর ফাঁসির আদেশ রদ করে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। এতে ফের চাঙ্গা হয়ে উঠেছে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠরা।

সাত খুন ঘটনার পর ভাতিজা শাহজালাল বাদল ১৫ মাস পলাতক ছিলেন। এরপর পলাতক থাকার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনে মুক্তি পান। সিদ্ধিরগঞ্জের ওভারব্রিজের সামনে থেকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোড় পর্যন্ত রাস্তার পাশের ফুটপাথ ও দোকানপাটে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন বাদল। সড়ক ও জনপথ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশাল জায়গা ও খাল দখল করে গড়ে তুলেছেন বিশাল টিনশেড মার্কেট। সম্প্রতি শিমরাইল মসজিদের পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে শতাধিক টিনশেড ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। সেখানে সামনে বাস কাউন্টার, পেছনে মার্কেট। প্রতিদিন গড়ে ১৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। বাদলের সহযোগী আব্দুল আজিজ, মহসিন ও ইসমাইল সেই টাকা তোলে। পুলিশকে মাসোহারা দিয়েই চলছে তার এ ব্যবসা। চাচা নূর হোসেন থেকে এ পদ্ধতি শিখেছেন তিনি। বাস কাউন্টারগুলো থেকে তার প্রতিদিনের আয় ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া ফুটপাথের আয়ের পাশাপাশি রয়েছে সানারপাড় গার্মেন্টের ঝুটসহ অন্যান্য ব্যবসা। বাদলের বাবা নূর সালাম জমি জবরদখল করে মানুষকে জিম্মি বানিয়ে চাঁদাবাজি করেন। এজন্য এলাকায় তাকে ‘বোবা ডাকাত’ নামে উল্লেখ করা হয়। নূর হোসেনের ৪টি ট্রলার থেকে প্রতিমাসে আয় হয় ৬ লাখ টাকা। ভাতিজা বাদলের মাধ্যমে পৌঁছে যায় নূর হোসেনের স্ত্রী রুমার কাছে। একইভাবে রসুলবাগের বাড়ি ভাড়া বাবদ উপার্জিত ১ লাখ টাকাও রুমা পেয়ে যাচ্ছেন। নূর হোসেনের বাড়ির পাশের মাছের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন তার বড় ভাই নূর ইসলাম। তার সহযোগী আক্কেল আলী টিপু ও আলীর মাধ্যমে ট্রাক টার্মিনালের দোকান ভাড়া ৭৮ হাজার টাকা প্রতিমাসে পাচ্ছেন রুমা। সিনথিয়া মত্স্য খামার রয়েছে তার ভাই নূর ইসলাম ও নুরুজ্জামান জজের দখলে। খামারের জমির মালিকদের নূর হোসেনের ভাইয়েরা কোনো টাকাই দেয় না। নূর হোসেনের সহযোগী শহীদ, সাইলো গেইটের রতন, ইয়াছিন, সাজ্জাদ ট্রাকস্ট্যান্ডের জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণ করছে। নাসিক নির্বাচনে ২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছিলেন নিহত খুন হওয়া নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। তিনি অব্যাহতি পাওয়া আসামি ইকবাল হোসেনের কাছে হেরে গেছেন। ইকবাল বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনের অর্থ জোগানদাতা হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। সাত খুনের মামলায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিনকে আসামি করেন বিউটি। ইয়াছিনসহ একটি পক্ষ বিউটির বিরোধিতা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াছিনসহ নূর হোসেনের অনুসারীরা এখন বিএনপির ইকবালের ঘনিষ্ঠ। তাদের চেষ্টাতেই তিনি নির্বাচিত হন বলে এলাকায় গুঞ্জন। শত চেষ্টা করেও ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরিফকে বাগে আনতে না পারায় সেভেন মার্ডারে নিহত নজরুলের সহযোগী সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি নজরুল ইসলাম ওরফে ছোট নজরুলকে গত নির্বাচনে সমর্থন দেন নূর হোসেন। কিন্তু তাকে জনগণ ভোট দেয়নি। ফলে নির্বাচিত হয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক আরিফুল হক হাসান। গুঞ্জন আছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নূর হোসেনের সমর্থন পেয়েছিলেন ছোট নজরুল।

৬ নম্বর ওয়ার্ডে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের আহ্বায়ক মতিউর রহমান সাত খুনের পর অনেক দিন পলাতক ছিলেন। নূর হোসেনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি আদমজী ইপিজেডে কয়েক কোটি টাকা আয় করে মতিউর। রটনা আছে তিনি মালয়েশিয়া ও মরিসাসে ‘সেকেন্ডহোম’ করেছেন। সাত খুনের ঘটনায় নজরুলের সঙ্গে নিহত স্বপনের ভাই মিজানুর রহমান খান রিপন ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচন করে হেরেছেন নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ আলী হোসেন আলার কাছে। আলাও নূর হোসেন সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন। নূর হোসেনের ভাই নুরুজ্জামান জজ এলাকায় ফিরেই কাঁচপুর সেতুর ঢালে আবদুল আউয়াল নামে এক ব্যক্তির জমি ভাড়া নিয়ে ‘জেরিন ট্রেডার্স’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বালুর ব্যবসায় নেমেছেন। এতে প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা আয় হয়। ২০১৩ সালে ২৭ লাখ টাকায় গাড়ি কিনেছেন। এখনো গাড়ির লাইসেন্স হয়নি। তবুও প্রশাসনের নাকের ডগায় নির্ভয়ে সেই গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। শীতলক্ষ্যার পাড়ে পাথরের ব্যবসাও জজের নিয়ন্ত্রণে। প্রতি ট্রাক পাথর লোড হলেই নূরুজ্জামান জজকে দিতে হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। নূর হোসেনের বডিগার্ড রিয়াদ এখন জজের বডিগার্ড। শিমরাইলে পরিবহনের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন নূর হোসেনের আরেক ভাতিজা সোহেল। বাসপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা এবং লেগুনা-টেম্পো থেকে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা করে আদায় করা হয়। তাছাড়া সোহেলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাছ বাজার এলাকার মাদকব্যবসাও। সাত খুনের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া বিএনপি নেতা হাসমত আলী হাসু এখন সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকার নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অফিসের ঠিকাদারিসহ সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন। নূর হোসেন মুক্তমানব থাকতে হাসুর মাধ্যমেই নূর হোসেন এ অফিস নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন হাসু নিজেই। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার্স ইনচার্জ আব্দুস সাত্তার জানান, অল্প কিছুদিন হল তিনি এ থানায় যোগদান করেছেন। তার কাছে চাঁদাবাজির বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেবেন।

 

সর্বশেষ খবর