শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিএনপি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

৪০ বছরেও সংকট কাটেনি দলের

শফিউল আলম দোলন

৪০ বছরেও সংকট কাটেনি দলের

আজ ১ সেপ্টেম্বর চল্লিশ বছরে পা রাখল দেশের অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি। প্রায় চার দশক আগে গঠিত দলটি আজ গভীর সংকটের মুখে। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী আজ বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা প্রতিনিয়ত ভুগছেন এসব মামলার সাজা আতঙ্কে। দুর্বল সাংগঠনিক তৎপরতায় নানা দিক থেকেই কর্মক্ষমতা ও সামর্থ্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছে পাঁচবার ক্ষমতায় যাওয়া এই দল। ১৯৭৮ সালের এই দিনে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এতটা সংকটে আর কখনই পড়েনি বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ দুর্নীতি মামলায় বিচারের মুখোমুখি। তার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। যে কোনো সময় রায় হতে পারে। দলের সিনিয়র সব নেতার বিরুদ্ধেই অর্ধ শতেরও বেশি করে মামলার খড়গ ঝুলছে। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যানের বড় ছেলে তারেক রহমানও মানিলন্ডারিং মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হত্যা মামলার বিচারও শেষ পর্যায়ে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা এক শত অতিক্রম করেছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বেশির ভাগ নেতার বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক মামলার সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে। সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকে দলটি এখন এতটাই সামর্থ্যহীন হয়ে পড়েছে যে, সরকার তথা পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশ কিংবা মিছিল শুধুই নয়, একটা ঘরোয়া বৈঠক পর্যন্তও করতে পারেন না নেতারা।  দলের সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল পরবর্তী ঢাউস আকৃতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হলেও রাজনীতির মাঠে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। প্রায় ৬০০ জনের নির্বাহী কমিটির ২০ জনও কখনো একত্রিত হতে পারেন না। অন্যদিকে— দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ-কোন্দলও চরমে। দলের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা একটি গ্রুপ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যেও সুকৌশলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে ফেলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দলের ভিতরে কেউ কাউকে এখন আর সহজে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে সরকারবিরোধী নিষ্ফল আন্দোলন করতে গিয়ে হাজার হাজার নেতা-কর্মী মামলা-হামলায় কাবু হয়ে পড়ায় দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বিশাল আকৃতির কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়েও এখন আর আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারছে না। ১৯৭৮ সালের আজকের এই দিনে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল— বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে দলটি নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে পাঁচবার দেশ শাসন করেছে। এর মধ্যে হুদা-মতিন, শাহ আজিজ, কেএম ওবায়দুর রহমান, অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন থাকাবস্থায় বেশ কয়েকবার ভাঙনের মুখে পড়ে বিএনপি। ২০০৭ সালের ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এ চরম দুঃসময় নেমে আসে দলে। শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অতঃপর প্রথমে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্তও দলটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। হাজার হাজার মামলার খড়গ, সরকারের দমননীতি তথা হামলা-মামলা, গুম, হত্যা মোকাবিলা করতে করতেই নেতারা হিমসিম খাচ্ছেন। এদিকে দলের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে গতকাল বাণী দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এতে তিনি বলেন, দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশজুড়ে গণহত্যা. গুম, গুপ্তহত্যা, নারী ও শিশুদের ওপর  পৈশাচিকতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মহোৎসব চলছে। দেশব্যাপী পথে-ঘাটে শুধু লাশের মিছিল। জনগণের অধিকার আদায়ে এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা আবারও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ৪০ বছরেও আর বিএনপি সংকটই কাটাতে পারছে না। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সবচেয়ে বেশি মানুষের সমর্থন নিয়েও সারা দেশে নেতা-কর্মীরা হতাশায় ভুগছেন। নেতারা এখন জনসমক্ষে একটা সভা-সমাবেশের আয়োজনও করতে পারেন না পুলিশের অনুমতি ছাড়া। দেশের স্বার্থেই বিএনপিকে ভালোভাবে বেঁচে থাকা দরকার। মুসলিম লীগ হয়ে কিংবা ভাসানী ন্যাপ হয়ে থাকাটাকে বেঁচে থাকা বলে না। তাই আজকের দিনে প্রতিজ্ঞা করা উচিত, তারা দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। আগাছা কেটে ফেলে দিয়ে প্রতিটি কর্মসূচিতেই নেতারা সাহসের পরিচয় দিবেন। তার মাধ্যমেই বেগম খালেদা জিয়া তৈরি করবেন জনতার মুক্তির সনদ। দলের জন্মদিন উপলক্ষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ৩৯ বছর পেরিয়ে ৪০-এ পা রেখেছে বিএনপি। এর মধ্যে দলের সাফল্য অনেক। ইতিমধ্যে পাঁচবার দেশ পরিচালনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে আজ সবচেয়ে জনপ্রিয় বৃহত্তম এ রাজনৈতিক দল হয়েও বর্তমান সরকারের দমননীতি আর গুম, খুনসহ ফ্যাসিবাদী আচরণে নানা সংকট পোহাতে হচ্ছে বিএনপিকে। সাংগঠনিক কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও সদস্য পদ নবায়নের কাজ চলছে। যা আগামী ১ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে। ইতিমধ্যেই ৬৫ লাখেরও বেশি সদস্য ফরম বিক্রি হয়েছে। আগামী এক মাসে তা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতে— বিএনপি সাফল্য যেমন আছে, তেমনি ব্যর্থতাও রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবিধান সংশোধন করে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করেন জিয়াউর রহমান। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল— বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে আমাদের শাসনকাল ছিল অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও সাফল্যমণ্ডিত।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি : ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে— নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আজ ভোর ৬টায় দলীয় পতাকা উত্তোলন। বেলা ১০টায় বিএনপি মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের নেতৃত্বে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ। প্রতি বছরই চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা জিয়ার মাজারে শ্রদ্ধা জানালেও এবার তিনি চিকিৎসার্থে লন্ডনে অবস্থান করায় যেতে পারছেন না। তবে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি আগামী ১২ সেপ্টেম্বর লন্ডনের রয়েল রিজেন্সি কনভেনশন সেন্টারে এক সমাবেশের আয়োজন করেছে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার। এ ছাড়া সারা দেশে সব ইউনিট কার্যালয়ে ভোর ৬টায় দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। স্থানীয় সংগঠনের সুবিধা অনুযায়ী দলের জেলা ও মহানগরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ইউনিটগুলো নানাভাবে দিবসটি পালন করবে। তবে বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতার মধ্য দিয়েই নেতাদের দিবসটি কাটানোর ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে হাই কমান্ডের। সারা দেশে চলমান বন্যার কারণে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মূল কর্মসূচি হিসেবে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কর্মসূচিকেই প্রাধান্য দিবে বিএনপি। তবে কেন্দ্রীয় বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টায় রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে।

সর্বশেষ খবর