শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কিশোর গ্যাংস্টার পাড়া মহল্লায়

সাখাওয়াত কাওসার

হঠাৎ করেই যেন আবারও বেপরোয়া হয়ে গেছে রাজধানীর কিশোর গ্যাংস্টার। শুরুতে ফ্যাশন, ফ্যান্টাসিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এক পর্যায়ে জড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধে। ভ্যাঁ, ভ্যাঁ শব্দে মোটরসাইকেল রেস, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব আবার এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে খুনখারাবি করতেও দ্বিধা করছে না। মাঝে কিছুদিন দমে গেলেও বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে বখে যাওয়া কিশোরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন নগরবাসী। ভয়ঙ্কর এসব কিশোরের ভয়ে অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ  দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। অভিভাবকদের উদ্বেগের পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে সমাজের পরিস্থিতিও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বখে যাওয়া এসব কিশোরের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। তবে তাদের নেপথ্য থেকে মদদ দিচ্ছে মহল্লার একাধিক রাজনৈতিক      বড় ভাই।  যে কোনো ধরনের অপকর্মে এদের বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা নেই। হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংসতাও ঘটাচ্ছে তারা অবলীলায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেদের কর্মকাণ্ডের খবর। রাস্তায় তুমুল বেগে গাড়ি, মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। তাদের কাছে থাকছে আগ্নেয়াস্ত্র। পাড়া-মহল্লায় গ্রুপ বেঁধে চলাফেরা করে ওরা। স্কুল-কলেজের মেয়েদের  দেখলেই মেতে ওঠে ইভটিজিংয়ে। আবার অনেক ভুক্তভোগী আদালত কেন্দ্রিক হয়রানি এবং নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মামলা করতেও ভয় পান। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মাহবুব আলম জানান, উত্তরার আদনান হত্যার পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে ম্যাসিভ ড্রাইভ দেওয়া হয়েছিল। কিশোর অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তবে এ বিষয়টি নিয়ে আরও কাজ করা হচ্ছে। 

গত ২৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর দারুস সালামের লালকুটি এলাকায় ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে শাহিন (১৬) নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কয়েকজন কিশোর। এ ঘটনায় ডালিম নামের এক কিশোরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ডালিম একটি গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছে। স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ বলছে, নিহত কিশোরও অনেকটা ডালিমের মতোই ছিল। তাদের নেপথ্য মদদদাতা এলাকার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা। নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে তারা ডালিমদের ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছেন মিরপুর বিভাগের একজন পুলিশ কর্মকর্তা। গত ২২ আগস্ট মঙ্গলবার উত্তর পীরেরবাগে কবির হোসেন (২১) নামে এক প্রিন্টিং কারখানার কর্মীকেও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে কুপিয়ে হত্যা করে কয়েক তরুণ।

গত ২ জুলাই ছোট-বড় (সিনিয়র-জুনিয়র) দ্বন্দ্বে রাজধানীর  শেখেরটেক ৬ নম্বর সড়কে সজল নামের এক কিশোর খুন হয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার চার আসামিকেই গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতে তারা ১৬৪ ধারায় নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকারও করেছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ শাহিনুর রহমান বলেন, আসামিরা সব স্থানীয় বখাটে। এদের মধ্যে দুজনের নামে আদাবর থানায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে মামলা আছে।

চলতি বছরের শুরুর দিকে বন্ধুস্থানীয়দের হাতে পর পর কয়েকজন কিশোর খুন হওয়ার পর কিশোর অপরাধ ও কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ উদ্বেগ ছড়ায়। রাজধানীর উত্তরায় কিশোরদের দুই দলের বিরোধে ৬ জানুয়ারি খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর। এ ঘটনার ১২ দিনের মাথায় তেজগাঁওয়ের তেজকুনীপাড়ায় ‘কে বড়, কে ছোট’ এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয় আবদুল আজিজ। এ দুটি ঘটনার মধ্যেই ১৫ জানুয়ারি রূপনগরে কামাল হোসেন নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ২ মার্চ শেওড়াপাড়া এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বাগ্?বিতণ্ডার একপর্যায়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কিশোর সজীব মিয়াকে। ২০ মে যাত্রাবাড়ীতে জাহিদুল হাওলাদার নামে একটি ফ্যান কারখানার কর্মী কিশোর হত্যার শিকার হয়েছে। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের হিসাব বলছে, তাদেও কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি।

গত ২৬ আগস্ট বেলা সাড়ে ১২ টা। রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের লেক ঘেঁষা একটি স্ন্যাক্সের দোকানের সামনে সাত-আটজন কিশোর মোটরবাইকে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এ সময় তাদেরই একজন মোবাইল ফোনে উচ্চৈঃস্বরে বলছিল, ‘আমার কথায় রাজি না হলে তোরে আমি খুন করে ফেলব। তুই আমারে চিনস না। এলাকার কেউ আমার সামনে কথা কওয়ারও সাহস করে না। আর তুই। ওই দিন দেখস নাই, পিস্তল দিয়া সেলিমরে কেমন ঠেক দিছিলাম।’ কিছু সময় পর ওই কিশোরেরা চলে গেলে জানা যায়, তার নাম দিহান। বাসা ধানমন্ডি এলাকায়। পড়াশোনা করছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সূত্র বলছে, রাজধানীর উত্তরা, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, আদাবর, পুরান ঢাকা, মতিঝিল, কাকরাইল ও মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এসব বখে যাওয়া কিশোরদের বিচরণ। এলাকাবাসীর অভিযোগ র‌্যাব-পুলিশের বিশেষ নজরদারি না থাকায় বখে যাওয়া কিশোররা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এদেও বেশির ভাগই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।

উত্তরায় এখনো দাপাচ্ছে ৩০টি গ্রুপ : উত্তরা এলাকায় কাকরা গ্রুপ, জি ইউনিট, ব্ল্যাক রোজ, রনো,  কে নাইট, ফিফটিন, ডিসকো বয়েস, নাইনস্টার, নাইন এম এম বয়েজ, পোটলা বাবু, সুজন, আলতাফ, ক্যাসল বয়েজ ও ভাইপার; পাওয়ার বয়েজ, ডিজে বয়েজ, জি স্টার, ফোর সিভি বয়েজ, সেভেন স্টার, ব্ল্যাক, কিং নাইন, দাদা বয়েজ,  রেড লাইট, প্রাণ টিএমসিসহ ৩০টির মতো গ্রুপ এখনো সক্রিয়। আদনান হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। তবে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

তেজগাঁওয়ে ১২ গ্রুপ : অনুসন্ধানে জানা যায়, তেজগাঁও এলাকার প্রতিটি দলে চার-পাঁচজন থেকে ১০-১২ জন করে সদস্য রয়েছে। ডেডলি রকার্স, কেইউ, এসকে ৩০, ইএস ১৩ এবং পিপিসহ বিভিন্ন নামের গ্রুপ এখনো সক্রিয়। স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ  নেতার নামে চলে ১৫-২০ জনের একটি গ্যাং। এই গ্যাংয়ের সব সদস্যের বয়স ১৮ বছরের নিচে।

স্থানীয় এক কমিশনারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত উজ্জ্বল ও ফরহাদের নেতৃত্বে আছে ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ। হায়দার ও সোহাগের নেতৃত্বে তেজগাঁও এলাকায় আছে আরেকটি গ্রুপ। তেজগাঁও থানার পাশে থার্ড গলির একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে ববি নামের এক কিশোর। স্টেশন  রোড থেকে তেজকুনি বাজার পর্যন্ত এলাকায় একটি গ্যাংস্টার গ্রুপের তৎপরতা রয়েছে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১০ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার নেতৃত্বে আছে একটি গ্রুপ। নাখালপাড়া, পলিটেকনিক কলেজ,  তেজকুনিপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় গ্যাংস্টার গ্রুপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

মোহাম্মদপুর ও আদাবরে ১০টি গ্রুপ বেপরোয়া : মোহাম্মদপুর এলাকায়ও উঠতি বয়সী ১৩টি কিশোর অপরাধী গ্রুপ সক্রিয়। এর মধ্যে বিহারি ক্যাম্প কেন্দ্রিক সাতটি গ্রুপ দাপিয়ে বেড়ায় পুরো মোহাম্মদপুর। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই এলাকার বেশির ভাগ গ্রুপই চলছে ব্যক্তির নামে। যেমন সলিমুল্লাহ রোডে তৎপর মামুন গ্রুপ। নূরজাহান রোডে সক্রিয় আলিফ গ্রুপ। আলিফ গ্রুপের সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। স্থানীয়রা জানায়, বাঁশবাড়ী কারখানা এলাকার নিয়ন্ত্রণ জসিম গ্রুপের হাতে। বিজলী মহল্লা এলাকা চলে ফিরোজের নেতৃত্বে। টাউন হলে সক্রিয় জলিল গ্রুপ। লালমাটিয়ায় নেতৃত্বে আছে সোহরাব ও রাজ্জাক। স্থানীয়রা জানায়, সোহেল বাবু নামের একজন দরগাহ শরিফ বানিয়ে এলাকায় ইয়াবা, ইন্টারনেটসহ নানা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। বাঁশবাড়ী কারখানা এলাকায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তরুণ ও কিশোরদের আড্ডা বসে। সলিমুল্লাহ  রোডের পানির ট্যাংক মাঠে আসর বসে মামুন গ্রুপের। আদাবর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে মশিউর রহমান মশু গ্রুপ। পুলিশ জানায়, এরা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, গ্যাং কালচার আগের মতো নেই। তবে কিশোরদের নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। সব কিছুই পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

বাদ নেই মিরপুর ও রমনা : 

পাড়া মহল্লা কেন্দ্রিক মিরপুর এবং রমনা এলাকায়ও দাপিয়ে বেড়ায় বখে যাওয়া কিশোররা। মিরপুরে অন্তত ১০ এবং রমনা এলাকায় ৭টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আহমেদ বলেন, বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল দেখলেই চেকপোস্টে আটকিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। মাঝেমাঝেই মিরপুর-কালশী রোডে অভিযান চালানো হয়। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে জনসচেতনতা  তৈরি করছি।

সর্বশেষ খবর