বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আশ্রয়ের খোঁজে শুধুই অপেক্ষা

খোলা আকাশের নিচে জন্ম দুই শিশুর

ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, হলুদিয়া (কক্সবাজার) থেকে

মিয়ানমারের বুসিদংয়ের কিনিচিং পাড়ার দুই রোহিঙ্গা নারী সালমা খাতুন ও রমজানা বেগম। ১৮ দিন হেঁটে এসে তারা মঙ্গলবার আশ্রয় পান উখিয়ার কুতুপালংয়ের একটি নুরানি মাদ্রাসায়। তবে এটা তাদের স্থায়ী ঠিকানা নয়। গতকাল সকালে বেরিয়ে পড়েন তারা নতুন ঠিকানার সন্ধানে। বিকালে বালুখালীর একটি পাহাড়ে আশ্রয় শিবিরে জায়গা হয় তাদের। শুধু তারাই নন, ওই মাদ্রাসায় দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছেন। এরপর সেখানে দু-এক দিন থেকে-খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে বেরিয়ে পড়বেন নতুন ঠিকানার খোঁজে।

এভাবেই প্রতিদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং, শিলের ছড়া, লম্বাশিয়া, মধুর ছড়া, বালুখালী, থাইংখালী, বাঘঘুনা, পালংখালী ঢালা পাহাড়; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির আচারতলী, চাকঢালা, ঘুমধুম ইউনিয়নের পঞ্চিমকূল, টিভি রিলে কেন্দ্র, টেকনাফের লেদা, মুছনীসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তাদের পুনর্বাসনে বন বিভাগের ৫ হাজার একর পাহাড় ও খাস জমিতে আশ্রয় শিবির গড়ে তোলা হচ্ছে। এর পরও ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই পায়নি। রাস্তার ধারে, খালে-বিলের কিনারে খোলা আকাশের নিচে পরিবার-পরিজন নিয়ে রাত কাটছে তাদের অর্ধাহার-অনাহারে।

কার্যত, সাম্প্রতিক সময়ে আসা ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখনো খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে গতকালও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। আগুন দেওয়া হয়েছে শাহপরীর দ্বীপের ওপারে কয়েকটি এলাকায়। সীমান্তে স্থলমাইনের শব্দ হলেও কোথাও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। যথারীতি ত্রাণের জন্য হাহাহার ছিল গতকালও। রাস্তার দুই ধারে অবস্থান নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ত্রাণের যানবাহনের দিকে তাকিয়েছিলেন রোহিঙ্গারা। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ আসায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখনো অনাহার-অর্ধাহারে। কূটনীতিবিদদের আগমনসহ বেসরকারিভাবে আসা ত্রাণের যানবাহনের কারণে কুতুপালং ও বালুখালী এলাকায় ছিল তীব্র যানজট। আওয়ামী লীগসহ বেসরকারিভাবে বেশকিছ সংস্থা ও ব্যক্তিকে ত্রাণ দিতে দেখা যায়। তবে বিএনপির ত্রাণের ট্রাক ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

সরেজমিনে কুতুপালং ও বালুখালী ঘুরে দেখা গেছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছু ত্রাণ দেওয়া হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। বৃষ্টি আর কাদাপানিতে আশ্রয়শিবিরগুলোর আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। খোলা আকাশের নিচেই রোহিঙ্গারা প্রস্রাব-পায়খানা করছে। গোসলেরও নেই কোনো সুব্যবস্থা। একের পর এক উজাড় হচ্ছে বনভূমি। নিধন করা হচ্ছে পাহাড়। হুমকির মুখে এখন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। বুসিদংয়ের টম বাজার থেকে কুতুপালং এলাকায় সাময়িক আশ্রয়শিবিরে চলে আসেন কাজী মোহাম্মদ ইমাম। গতকাল পর্যন্ত তার কোনো আশ্রয় জোটেনি। কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়েও স্থান পাননি তিনি। চলে যান বালুখালী। হেফজুর রহমান নামে এক যুবকেরও একই অবস্থা। আশ্রয়ের খোঁজে তাকেও দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। কুতুপালং থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত এভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়ে ত্রাণের অপেক্ষায় রয়েছে।

খোলা আকাশের নিচে জন্ম নিল যমজ সন্তান : মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আবারও খোলা আকাশের নিচে জন্ম নিল যমজ ভাইবোন। ঘুমধুম এলাকার বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতুসংলগ্ন খোলা আকাশের নিচে এ যমজ সন্তানের জন্ম হয়। বর্তমানে যমজ শিশু ও মা সিএনএফ হাসপাতালে রয়েছেন। মা কিছুটা অসুস্থ থাকলেও দুই সন্তান ভালো আছে বলে জানা গেছে।

চার রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার : মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় নাফ নদে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি নৌকাডুবির ঘটনায় আরও চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া এলাকায় মঙ্গলবার রাতে এই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। গতকাল সকাল ৭টার দিকে জালিয়াপাড়ায় নদী থেকে এক নারী ও এক শিশুর লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয় লোকজন।

বান্দরবানে চার রোহিঙ্গা আটক : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করার সময় চার রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি। গত রাতে তাদের আটক করা হয় বলে নাইক্ষ্যংছড়ি ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ারুল আজম জানান। খবর বিডিনিউজের। আটকরা হলেন মিয়ানমারের মংডুর আনোয়ার (৪০), জাফর (৪৫), আজমল (৩৮) ও কালু মিয়া। কর্নেল আনোয়ারুল বলেন, ওই চার রোহিঙ্গা সন্দেহজনকভাবে সীমান্তের ৪৬ নম্বর পিলারের পাশে ঘোরাঘুরি করার সময় তাদের আটক করা হয়। তাদের ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

 সেখান থেকে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন তাদের স্বজনরা রয়েছেন বাংলাদেশের টেকনাফ এলাকার কোন শরণার্থী শিবিরে। সিদ্ধান্ত নেন, ভারত থেকে তারা বেনাপোল হয়ে শরণার্থী শিবিরে স্বজনদের কাছেই যাবেন। গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বেনাপোল সীমান্তের খলসী এলাকার একটি রাস্তা থেকে বিজিবি সদস্যরা জাহিদ হোসেন ও আজিজুল হককে আটক করে।

এ সময় জাহিদ হোসেনের সঙ্গে তার স্ত্রী ইয়াসমিন (১৯), দুই বছরের ছেলে আরমান, ৯ মাস বয়সী ছেলে ইমরান এবং আজিজুল হকের সঙ্গে তার স্ত্রী আফসা (২৪), ৭ বছর বয়সী ছেলে ইকবাল হোসেন ও ৪ বছর বয়সী ছেলে হাফিজুর ছিল। বিজিবি সদস্যরা এ আটজনকে গতকালই বেনাপোল পোর্ট থানায় সোপর্দ করেন। পরে বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশ এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিরাপদ হেফাজতে প্রেরণের আবেদন জানিয়ে যশোর আদালতে প্রেরণ করে। যশোরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক বুলবুল ইসলাম ৮ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যশোর জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এদিকে নারী-শিশুসহ এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যশোর আদালতে নেওয়া হলে সেখানে উত্সুক জনতা ভিড় করেন। অনেকেই তাদের কাছে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কাহিনী শুনতে চান। স্থানীয় লোকজন এমনকি আদালতের কর্মচারীরা পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কাহিনী শুনে অবাক হয়ে যান। সবাই তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। অনেকেই তাদের টাকা দিয়েও সাহায্য করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর