শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাদের ত্রাণে চরম বিশৃঙ্খলা

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় শরণার্থীরা উখিয়া-টেকনাফ সড়কে যানজট

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, (বালুখালী) কক্সবাজার থেকে

রোহিঙ্গাদের ত্রাণে চরম বিশৃঙ্খলা

ত্রাণের আশায় উখিয়ার মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছে রোহিঙ্গারা। কিছু পেলেই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সবাই —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ সেল খোলা হয়েছে কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকার প্রবেশদ্বারেই। সেখানে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবীরাও রোহিঙ্গাদের জন্য আসা ত্রাণের নিবন্ধনে সহায়তা দিচ্ছেন। গতকাল বেলা ১২টার দিকে দেখা যায়, ৪৫৫টি ত্রাণবাহী গাড়ি ও পণ্যের নাম নিবন্ধিত হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা এসব ত্রাণ নিয়ে এসেছেন। সরকারি কোনো ত্রাণের নিবন্ধন সেখানে হয়নি। অন্য কোথাও নিবন্ধন হচ্ছে কিনা তাও বলতে পারেননি কেউ। তবে সেখান থেকে একটি অনুমতিপত্রের স্লিপ নিয়ে ত্রাণ নিয়ে আসা লোকেরা কুতুপালং থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যেখানে-সেখানে ত্রাণসামগ্রী বিলাচ্ছেন। গতকাল দিনভর কুতুপালং থেকে পালংখালী পর্যন্ত মহাসড়কে

সরেজমিন দেখা গেছে, ত্রাণবাহী গাড়ির লোকদের বড় অংশই মহাসড়ক থেকে রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে ত্রাণ ছুড়ে মারছেন। প্রাণ বাঁচিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাও জীবনবাজি রেখে ছুটছেন ত্রাণের দিকে। গত বৃহস্পতিবার এভাবে ত্রাণ ধরতে গিয়ে এক রোহিঙ্গা গাড়িচাপায় মারাও গেছেন। এরই মধ্যে অনেকেই আহত হয়েছেন। তবুও তাদের ত্রাণ চাই, ত্রাণ। কার্যত, এখনো ত্রাণ বিতরণে কোনো সমন্বয় নেই। চরম বিশৃঙ্খলা। যে যার মতো করে ত্রাণ দিচ্ছেন। এ নিয়ে সরকারিভাবে উচ্চ পর্যায়ের কোনো কমিটিও করা হয়নি। সরকারি ত্রাণ বিতরণও কোথাও দেখা যায়নি। কেউ কেউ বলেছেন, বনবিভাগের দেওয়া দুই হাজার একর জমি এলাকায় তাঁবু তৈরিতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু ত্রিপল দেওয়া হয়েছে। ব্যতিক্রম চিত্রও পাওয়া গেছে কোনো কোনো স্থানে। মহাসড়ক থেকে একটু ভিতরে বনবিভাগের জায়গায় লাইন ধরিয়ে টোকেনের ত্রাণ দিচ্ছেন অনেকেই। টোকেন থাকা সবাই ত্রাণ পাচ্ছেন। দাওয়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনকে দেখা গেছে বনবিভাগের একটি ফাঁকা জায়গায় তিন হাজার রোহিঙ্গাকে টোকেন দিয়ে লাইন ধরিয়ে বসিয়ে ত্রাণ দিচ্ছে।

এদিকে যত্রতত্র ত্রাণ দেওয়ায় উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মহাসড়কে এখন যানজট চরমে। ১০ মিনিটের পথে সময় লাগছে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। এ ছাড়া যাত্রীবাহী যানজটেও সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। যানজট নিয়ন্ত্রণেও নেই কোনো কার্যকর ভূমিকা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ততা বেশি ভিআইপিদের নিয়ে। ত্রাণশিবিরে ভিআইপি কেউ এলে দুর্ভোগ আরও বাড়ে বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।

স্থানীয় সর্বসাধারণের অভিযোগ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে। চালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। পিয়াজ, মরিচসহ অন্য সামগ্রীর দামও আকাশচুম্বী। বিগত নির্বাচনে ৫ নম্বর পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহাদাত হোসেন জুয়েল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘মানবিক কারণে আমরা এলাকাবাসী সরকারের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু আমরা এখন চরম ভোগান্তিতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও যেতে পারি না। যানবাহন নেই বললেই চলে। দুর্গন্ধে সয়লাব আশপাশের এলাকা। জিনিসপত্রের দামে অস্থিরতা। এই দুঃখের কথা কাকে বলব।’ মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান এলাকা থেকে আসা একটি সংগঠনের কয়েকটি ত্রাণবাহী ট্রাক থেকে রোহিঙ্গাদের দিকে গার্মেন্টের পোশাক নিক্ষেপ করা হচ্ছে। থাইংখালী এলাকায় রহিমা খাতুন নামে এক রোহিঙ্গা নারী ছুড়ে ফেলা ত্রাণ ধরতে গিয়ে শিশুসন্তানসহ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান। এ সময় ত্রাণের অন্য সংস্থার গাড়ি সামনে চলে এলেও ব্রেক করার কারণে অল্পের জন্য রক্ষা পান। অবশ্য ট্রাক থেকে ছোড়া দুটি প্যান্ট ধরতে তিনি সক্ষম হন। অপ্রয়োজনীয় মনে করে ওই নারী এক পর্যায়ে রাস্তার পাশেই ওই প্যান্টগুলো ফেলে রেখে চলে যান। তার মতো অসংখ্য নারী, বৃদ্ধা ও শিশু ত্রাণের জন্য ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার মাঝখানে চলে আসেন। ত্রাণের বড় অংশই গার্মেন্ট পণ্য হওয়ায় অনেকেই তা ফেলে দেন।

তাঁবু নেই যার, ত্রাণ নেই তার : এদিকে যারা এখনো তাঁবু পাননি তারা তালিকার মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের অধিকাংশই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছুড়ে ফেলা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। মরিয়ম বিবি নামে এক নারী অভিযোগ করেন, তিনি কুতুপালং এসে আশ্রয় নিয়েছেন তিন দিন হলো। কিন্তু এখনো তাঁবু পাননি। তাকে কেউ ত্রাণের টোকেনও দেয় না। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তার মতো হাজার হাজার শরণার্থী রাস্তার ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন।

সর্বশেষ খবর