রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মিল মালিকদের কারসাজিতে অস্থিরতা

নিজামুল হক বিপুল

এক লাফে চালের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের পকেট কেটে নিচ্ছে মাত্র ১০-১২ জনের একটি সিন্ডিকেট। বড় মিল মালিকদের এই সিন্ডিকেট নানা অজুহাতে এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিদিনই চালের দাম বাড়াচ্ছে মিল গেটে। যার ফলে ঈদের আগেও যে মিনিকেট চালের দাম ছিল খুচরা বাজারে কেজি প্রতি ৫৬ টাকা, সেই চালই এখন বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৬৫ টাকা। একইভাবে নাজিরশাইল চাল প্রকার ভেদে বিক্রি হয়েছিল ৬১ টাকা থেকে ৬৬ টাকায়, সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকা থেকে ৭৫ টাকায়। আর মোটা চাল হিসেবে পরিচিত স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ টাকা। ঈদের আগে এই চালের দাম ছিল ৪৪ টাকা। মিল মালিকদের কারসাজিতে চালের দাম কমছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, গতকাল নওগাঁ এবং কুষ্টিয়ায় মিল গেটে চালের দাম বাড়েনি। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা চালের বাজারের এই অস্থিরতার জন্য সরাসরি দায়ী করছেন বড় অটো রাইসমিল মালিকদের। একইভাবে চালের সবচেয়ে বড় মোকাম হিসেবে পরিচিত নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার খাজানগরের ছোট ছোট রাইসমিল মালিকরাও বলছেন, বড় অটো রাইসমিল মালিকদের সিন্ডিকেটই চালের বাজার অস্থির করে তুলেছে। ঢাকার একাধিক পাইকারি ও খুচরা বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণত প্রতি বছর ঈদের সময় চালের দাম কেজিতে এক-দুই টাকা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঈদের বন্ধ শেষ হলে ১৫ দিনের মধ্যেই দাম আগের জায়গায় চলে যায়। কিন্তু এবার সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মিল মালিকরা ঈদের বন্ধ এবং ধান নেই এমন অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে চালের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের লোকজন সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র এবং স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন। কারণ দাম বৃদ্ধির ফলে তারা বেশি চাল কিনতে পারছেন না। আবার চাল মজুদ করতে সাহসও পাচ্ছেন না, যদি চালের দাম আবার কমে যায় এই ভয়ে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঈদের বন্ধের পর প্রথম দফায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়েছে মূলত মিল মালিকদের কারসাজিতে। আর গত তিন-চার দিনে সেই অস্থির বাজারে ঘি ঢেলেছে আমদানিকারকদের কারসাজি। ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে— এমন মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে দাম বৃদ্ধি করে দিয়েছেন আমদানিকারকরাও। যাদের একটা অংশ আবার বড় মিল মালিকদের সঙ্গে একাট্টা। কুষ্টিয়ার খাজানগরের একাধিক মিল মালিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, চালের বৃহৎ মোকাম খাজানগরে ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ৫০০ মিল রয়েছে। যার মধ্যে অটো রাইস মিলের সংখ্যা ৩০টি। এই ৩০টির মধ্যে আবার বড় মিলার রয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন। তারাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন চালের এই মোকাম। তাদের ইশারায়ই চালের দাম ওঠানামা করে। একজন মিল মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আমরা তো ক্ষুদ্র মিল মালিক। চাইলেও বাজারে প্রভাব ফেলতে পারব না। কিন্তু রশিদ এ্যাগ্রোর আবদুর রশিদ, দৌলতপুরের বিশ্বাস এ্যাগ্রোর বায়েজিদ বিশ্বাসসহ এই শ্রেণির বড় মিল মালিক যারা তারাই সব কিছু করেন। সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে ভ্রাম্যমাণ আদালত যখন খাজানগরে অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, বিশেষ করে আবদুর রশিদের মিলে অভিযান চালায় তখন রশিদ সংশ্লিষ্ট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু ম্যাজেস্ট্রেট তার ফোন আমলে নেননি এবং কথাও বলেননি। এতেই রশিদ ক্ষুব্ধ। এর পরদিনই মিল গেটে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় মিনিকেটসহ অন্যান্য চালের দাম। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ওই দিন আবদুর রশিদ স্থানীয় সাংবাদিকদেরও হুমকি দিয়েছেন। সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন কুষ্টিয়ার খাজানগর ও নওগাঁর মোকামের ১০ থেকে ১২ জন বড় মিল মালিক। তাদের কাছে হাজার হাজার টন চাল মজুদ আছে। ধানের মৌসুমে তারা হাজার হাজার টন ধান কিনে মজুদ করে রেখেছেন। সেই ধান থেকেই এখন চাল তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। এদের সম্পর্কে প্রশাসনও জানে। তারা স্থানীয় প্রশাসনের ওপরও প্রভাব খাটান। তাই তাদের বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না। ফলে তারা যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ান। স্থানীয় ছোট মিল মালিকরা বলছেন, সরকার যদি কঠোর মনোভাব না নেয় তাহলে এই সিন্ডিকেট ক্রমেই অস্থির করে তুলবে বাজারকে। ঢাকার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পাইকারি আড়তের ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন বলেন, মিল মালিকদের কারসাজিতে গত কয়েকদিন ধরে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। ফলে আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছি। ঈদের আগে যে মিনিকেট চাল মিল গেট থেকে কিনেছি ৫৩-৫৪ টাকায়, সেই চালই গতকাল কিনতে হয়েছে ৬০ টাকা ৫০ পয়সা দরে। একইভাবে যে নাজিরশাইল চাল মিল গেট থেকে কেজি প্রতি কিনেছিলাম ৫৮-৫৯ টাকায়, সেই চালই এখন কিনতে হচ্ছে ৬২-৬৩ টাকায়। আবার ভালো মানের নাজির শাইল প্রতি কেজি ঈদের আগে কেনা গিয়েছিল ৬১-৬২ টাকায়, সেই চাল এখন ৬৫-৬৬ টাকায়।

আক্তার বলেন, ভারতীয় মোটা চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে জানিয়ে আমদানিকারকরা তাদের (পাইকারদের) কাছে শুক্রবারও বিক্রি করেছেন ৫০ টাকা ৫০ পয়সা দরে। অথচ এই চাল ঈদের আগে বিক্রি হয়েছে ৩৯ টাকা থেকে ৪৩ টাকা পর্যন্ত। অথচ ভারত চাল রপ্তানি বন্ধই করেনি। শুধু মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আমদানিকারক ও মিল মালিকরা। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরাসরি মিল মালিকদের দায়ী করে এখনই ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মিল মালিকরা বেশি মুনাফা লাভের আশায় চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছেন। এখনই সরকারি হস্তক্ষেপ না করা হলেও পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, গতকাল মিল গেটে মিনিকেটসহ কোনো চালের দামই বাড়েনি। গতকাল মিল গেটে প্রতি কেজি মিনিকেটের দাম ছিল ৬০ টাকা। একইভাবে বিআর-২৮ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৫-৫৬ টাকা এবং স্বর্ণা চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪৫-৪৬ টাকায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভারত থেকে যে চাল এন শংকর মিনিকেট (মোটা চাল) এসেছে, সেই চাল স্থানীয় বিভিন্ন মিলে ঢুকিয়ে লেভেল পরিবর্তন করে স্থানীয় মিল মালিকদের লেভেলে বিক্রি করা হচ্ছে। দামও বেশি নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে গতকাল কুষ্টিয়ার মিল মালিকদের সঙ্গে বার বার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। কুষ্টিয়া মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন। দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে চাল আমদানি বেশি হওয়ায় দেশের বাজারে চালের সরবরাহ আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে এর সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। আমদানি ও পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও ধানের জেলা খ্যাত দিনাজপুরসহ এই অঞ্চলেও বেড়ে চলেছে চালের দাম। এ ব্যাপারে মিল মালিকদের কারসাজিকেই দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। দিনাজপুর চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন জানান, আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। এক্ষেত্রে মিল মালিকদের কোনো কারসাজি নেই। দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাওছার আলী জানান, পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক। হিলি স্থলবন্দর পরিচালনাকারী পানামা হিলি পোর্ট লিংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক অসিত কুমার স্যান্নাল জানান, চাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর পর থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে চাল আমদানির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। বর্তমানে বন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৬০ থেকে ১০০ ট্রাক করে চাল আমদানি হচ্ছে। প্রতি ট্রাকে প্রায় ৩৫ মে.টন চাল থাকে।

বগুড়ায় মিল মালিকদের সভা : নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া থেকে জানান, গতকাল দুপুরে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বীরগ্রামের একটি অটো রাইস মিলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের ১১০ জন মিল মালিক উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবদুর রশীদ। সভায় সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও সভা শেষে সভাপতি আবদুর রশীদ জানান, ধান বেশি দামে কিনে, চাল কম দামে বিক্রি করার চাপ দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সামঞ্জস্য রেখেই সরকার ও মিল মালিকদের সমন্বয়ে চালের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। ১৯ সেপ্টেম্বর খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী এবং কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক রয়েছে। সেই বৈঠকে মালিকদের দাবি নির্ধারণের জন্য সভার আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু ম্যজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত করলে হবে না। তদন্ত না করে মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অপবাদ চাপানো থেকে বিরত থাকতে মিডিয়ার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর