বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিসার ভয়াবহ আড্ডায় তরুণরা

ঢাকার ১০৪ বারে নেশার রাজ্য

সাখাওয়াত কাওসার

সিসার ভয়াবহ আড্ডায় তরুণরা

রাজধানীর উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সড়কের একটি অভিজাত গেস্টহাউস। বাইরে থেকে গেস্টহাউসের সাইনবোর্ড লাগানো থাকলেও ভিতরে আলো-আঁধারির খেলা। কালো কাচে ঘেরা তৃতীয় তলার একটি অংশ এবং রুফটপের প্রতিটি টেবিল সাজানো রাজকীয় হুক্কা দিয়ে। হালকা ভলিউমে বাজছে ইংরেজি গান। সন্ধ্যার পর থেকে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ বুঁদ হয়ে থাকেন সিসার টেবিলে। গুলশান-২ নম্বরের ১১৩ নম্বর সড়কের একটি ছয়তলা অভিজাত হোটেলের ভিতরের চিত্রও অনেকটা একই। শুধু উত্তরা কিংবা গুলশান নয়, ধানমন্ডি, নিকুঞ্জ, নিকেতন, মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ১০৪টি সিসা বারের তালিকা তৈরি করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। তবে রাজধানীতে এর প্রকৃত সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে।

দেশের মাদক আইনে সিসা অন্তর্ভুক্ত না থাকায় সিসা নিয়ে কোনো আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে পারছেন না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০-এর সংশোধনীতে মাদকদ্রব্য হিসেবে সিসা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। চলতি সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘দিনকে দিন সিসা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। বিদ্যমান মাদক আইনে না থাকলেও মাদকদ্রব্য আইন, ১৯৯০-এর সংশোধনীতে শিগগিরই তা রাখা হবে বলে আমরা আশা করছি।’

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, সিসায় মাদকের উপাদান না পাওয়া গেলেও এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। একটি সিসায় প্রতি সেশনে বের হওয়া ধোঁয়ার পরিমাণ ১০০টি সিগারেটের সমান। এর মধ্যে উচ্চমাত্রার টক্সি, কার্বন মনো-অক্সাইড হেভি মেটালসহ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান থাকে। এতে নিকোটিনের পরিমাণও সিগারেটের দ্বিগুণ। সিসায় আসক্ত হয়ে অনেকেই ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকসেবী হয়ে উঠছে। হাসিসের নির্যাস থেকে রাসায়নিক মিশ্রণে তৈরি হয় সিসায় ব্যবহার করা উপাদান টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল।  এক কেজি টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল তৈরি করা যায় ১২০ কেজি হাসিস থেকে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম সিকদার বলেন, ‘রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডিতে গড়ে ওঠা সিসা বারে আমরা বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেছি। সেখান থেকে সংগৃহীত নমুনায় তিনটি ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। তবে মাদক আইনে সিসা না থাকায় আমরা সিসা বার বন্ধ করে দিতে পারছি না, যা মানুষের দেহের জন্য মাদকের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। তবে এসব বারে বিভিন্ন সময় নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার হয় বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিসার খদ্দেরদের মধ্যে রয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উঠতি ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার তরুণ-তরুণী। প্রথমে এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার থেকে সিসা গ্রহণ করলেও পরবর্তী সময়ে তারা ইয়াবা, ফেনসিডিল, হোরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃষ্টি আহমেদ ও কনক আহমেদ (ছদ্মনাম) ধানমন্ডি এলাকার দুটি অভিজাত পরিবারের সন্তান। দুজনই পড়ছেন রাজধানীর প্রথম সারির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শখের বশে টানতে গিয়ে এখন তারা নিয়মিত সিসাসেবী। বনানীর একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে আসা-যাওয়া শুরু করার পরই সিসায় মজেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৈকত আহমেদ। আগে কেবল সিগারেটে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তার একদিনও চলে না সিসা ছাড়া। শুধু বৃষ্টি, কনক কিংবা সৈকত নয়, রাজধানীর উচ্চবিত্ত পরিবারের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী এখন সিসায় আসক্ত। সিসাসেবী একাধিক তরুণ-তরুণীর সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, শুরুর দিকে তারা কেবল ফ্যাশনের জন্য সিসা সেবন করলেও এখন নিয়মিত সিসা বারের খদ্দের। র‌্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘সিসায় অনেক যুবক-যুবতী আসক্ত হয়ে পড়ছে এমন অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। সিসা বারগুলোতেও বিভিন্ন সময় মাদক মিশিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই আমরা অভিযান চালাব।’ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও অনুসন্ধানে জানা যায়, সেই মুঘল আমল থেকে সিসার প্রচলন। বিভিন্ন ফলের নির্যাস দিয়ে তৈরি হয় সিসার উপাদান। কিন্তু বাংলাদেশে এর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে হেরোইন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। এদিকে সিসার বার এবং এতে আসক্ত তরুণ-তরুণীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সিটি করপোরেশন থেকে সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে নগরীর বিভিন্ন নামি-দামি রেস্টুরেন্ট দেদার চালিয়ে যাচ্ছে সিসার বার। যদিও রেস্টুরেন্টের মালিকরা সিসায় কোনো মাদকদ্রব্য মেশানো হয় না বলে দাবি করছেন।

সর্বশেষ খবর