বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সংকটের শেষ নেই রোহিঙ্গা শিবিরে

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্পে তীব্র খাবার পানি সংকটের পাশাপাশি রয়েছে স্যানিটেশন সমস্যা। নারী-শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। একদিকে পাচার হয়ে যাওয়ার ভয় অন্যদিকে আছে যৌন নির্যাতনের শঙ্কা। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ও একশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরেজমিন ঘুরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার জিন্নাতুন নূর-এর কাছে তুলে ধরেন

 

ক্যাম্প থেকে শিশু-নারী পাচারের আশঙ্কা আছে

—অ্যাডভোকেট এলিনা খান

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান সরেজমিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পঘুরে রোহিঙ্গাদের যে অবস্থা দেখেছেন তাকে তিনি ‘ভয়াবহ’ বলেছেন। তবে তিনি মনে করছেন রোহিঙ্গা শিশুদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

এলিনা খান বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই ধরনের শিশু আছে। এর মধ্যে একদল হচ্ছে চার থেকে শুরু করে ১০ বছর বয়সী, আর অন্যদল সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতক। এ ছাড়া বয়স্ক লোকদেরও চোখে পড়েছে। যাদের বয়স ৪৫ বছরের ওপরে। আর যুবকের সংখ্যা খুবই কম। নবজাতক কোলে থাকায় ত্রাণ সংগ্রহে যেতে পারছেন না মা। আর খাবার না পেয়ে সেই কোলের শিশুও মায়ের বুকের দুধ পাচ্ছে না। নবজাতক শিশুদের খাওয়ার উপযোগী খাবারও কেউ ত্রাণ হিসেবে দিচ্ছে না। ফলে এই শিশুগুলো অভুক্ত থাকছে। আমরা এমন ধরনের কিছু মাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। অন্যদিকে ছোট শিশুরা ত্রাণের গাড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আমরা দেখেছি যে, স্থান না পেয়ে নবজাতক কোলে নিয়ে এক মা একটি ঝোপের ভিতরে বসে আছেন। তবে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ হিসেবে যেসব কাপড় পাঠানো হচ্ছে তা ব্যবহার অনুপযোগী। ওই ধরনের কাপড় ব্যবহারে তারা অভ্যস্তই নন। ফলে তারা সেগুলো ফেলে দিচ্ছেন’। বালুখালী ক্যাম্পে যাওয়ার সময় বেশকিছু অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক দৃশ্য দেখেছেন এই মানবাধিকারকর্মী। আর তিনি আশঙ্কা করছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান নেওয়া শিশুদের পাচারের ঝুঁকি আছে। এলিনা খান বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি যে, একটি গাড়িতে একই বয়সী বেশ কয়েকটি শিশুকে বসিয়ে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা বিষয়টি জানার জন্য গাড়ি থামানোর চেষ্টা করলেও শরণার্থীদের চাপে সে স্থান পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ পাইনি। তার আগেই গাড়িটি স্থান ত্যাগ করে। আবার আরেকটি দৃশ্য দেখেও অবাক হয়েছি। ক্যাম্পে ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু এই বয়সী কিশোরীদের একটি দলকে নতুন জামা পরিয়ে বাসে করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে, এই বয়সী মেয়েরা ক্যাম্প থেকে নতুন জামা পরে বাসে চড়ে কোথায় যাচ্ছে! আর এই মেয়েগুলোকে যারা নিয়ে যাচ্ছিল তারা রোহিঙ্গা, না স্থানীয় বাসিন্দা?’ ত্রাণ বিতরণ কাজের মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব আছে বলে মনে করছেন এলিনা খান। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পে যারা রাস্তার ধারে অবস্থান করছেন ত্রাণ শুধু তারাই পাচ্ছেন। অথচ যারা ক্যাম্পের ভিতরে অবস্থান করছেন তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ক্যাম্প থেকে অনেকেই গৃহকাজের জন্য মেয়ে ও নারীদের নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন ক্যাম্প থেকে ফিরছি তখন দেখলাম একটি গাড়িতে ভালো পোশাক পরিহিত দুই যুবকের সঙ্গে দুটি কিশোরী মেয়ে এবং বোরকা পরিহিত আরেকজন নারী। আমাদের সঙ্গে থাকা লোকেরা রোহিঙ্গাদের ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা সরে গিয়ে বসেন এবং কোনো কথা বলেননি। এ ধরনের সন্দেহজনক আরও বেশকিছু ঘটনার ভিতরে কোনো রহস্য আছে কিনা সেখানে কয়েক দিন অবস্থান করলে হয়তো জানা যেত। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। আমি মনে করি পুলিশ দিয়ে এ ঘটনা থামানো যাবে না। বিজিবিকে কঠোরভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সঙ্গে কিছু নারীবাদী সংগঠন বা এনজিওকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মাধ্যমে নারী-শিশুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আর এটি করা না গেলে অনেক মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হবে বলে আশঙ্কা করছি।’

 

খাবার পানির সংকট স্যানিটেশন সমস্যা

—ফারাহ কবীর

‘বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী লবণ উৎপাদনের কাজে ব্যবহূত প্লাস্টিক ও বাঁশ দিয়ে কোনোমতে তাঁবু টাঙিয়ে অবস্থান করছেন। সেখানেই তারা রান্না করছেন, আবার সেখানেই ঘুমাচ্ছেন। এ ক্যাম্পে খাবার পানির যেমন সংকট তেমন স্যানিটেশনেরও সমস্যা আছে। পুরো ক্যাম্পে আছে মাত্র একটি টিউবওয়েল।

আর মলমূত্র ত্যাগের জন্য টয়লেট না থাকায় পুরুষরা কোনোমতে খোলা স্থানে সে কাজ করতে পারলেও নারীরা লজ্জায় পড়েছেন। আর ক্যাম্পে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ একসঙ্গে জনবসতি গড়ার ফলে রান্নার আগুন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।’ অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর এসব কথা জানান। তিনি আরও বলেন, ‘রাতে সেখানে কোনো বাতির ব্যবস্থা নেই। আলো জ্বালাতে হয় মোমবাতি দিয়ে। ক্যাম্পে থাকা মানুষগুলো জানেন না যে, তাদের ভবিষ্যৎ কী, তারা এখন কেবল বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন। ত্রাণের আশায় রাস্তার দুই ধারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন।’ ফারাহ কবীর বলেন, ‘আমাদের নীতিনির্ধারকদের সুপরিকল্পিতভাবে চিন্তা করে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। আর এ কাজে সমন্বয় থাকতে হবে। অনেককেই দেখেছি শরণার্থীদের ত্রাণ হিসেবে কাপড় দিচ্ছেন। কিন্তু এ কাপড় কি আদৌ রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনে আসছে? আমরা আরও দেখেছি রাস্তার দুই পাশে প্রচুর কাপড় পড়ে আছে। অথচ এ মুহূর্তে শরণার্থীদের কাছে কাপড়ের থেকে বেশি প্রয়োজন পানি ও খাবারের। ত্রাণ হিসেব তাদের শুধু চাল দিলেই হবে না কারণ এই চাল রান্নাও করতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শুকনো খাবার দিতে হবে। যেহেতু আগতদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু ও নারী। আর তাদের জেন্ডারবেজড ভায়োলেশনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। এজন্য নারী-শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের ওষুধ কোম্পানি, চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে এগিয়ে আসতে হবে। তারা এখন যে অবস্থায় আছে এতে তাদের মহামারীতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও আছে। যেহেতু সরকার এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। এজন্য রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে সমন্বয় আনতে সরকার মিডিয়ার মাধ্যমে কিছু গাইডলাইন দিতে পারে।’ ফারাহ কবীর বলেন, ‘একইসঙ্গে এখনই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর জন্য সেখানে কী পরিমাণ টয়লেট এবং পানীয় পানি ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তা ঠিক করার জন্য বিশেষজ্ঞ মহলকে পরিকল্পনা করতে হবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে এমডিজি অর্জন করেছে কিন্তু রাখাইন থেকে আসা শরণার্থীদের কারণে এর ওপর প্রভাব পড়তে পারে; এজন্যও সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকতে হবে।’

সর্বশেষ খবর