বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কালোবাজারে বন্ডের পণ্য শুল্কফাঁকি ৬৭১ কোটি টাকা

বন্ড লাইসেন্সধারী ৪৭৯ প্রতিষ্ঠানে নজরদারি নেই

রুহুল আমিন রাসেল

বন্ড সুবিধার নামে আমদানি হওয়া পণ্য হাত বাড়ালেই মিলছে কালোবাজারে। আদালতে কয়েকশ প্রতিষ্ঠানের অবৈধভাবে পণ্য অপসারণ সংক্রান্ত ৩৬৭টি মামলাও চলছে। এতে শুল্কফাঁকির পরিমাণ প্রায় ৬৭১ কোটি টাকা। এমনকি শিল্প-কারখানার অস্তিত্ব নেই, এমন বন্ড লাইসেন্সধারী ৪৭৯ প্রতিষ্ঠানে কার্যত কোনো নজরদারিই নেই সরকারের। ফলে থামছে না শুল্কফাঁকি। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্য ফ্রি-স্টাইলে বিক্রি হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত আমদানি প্রাপ্যতা নির্ধারণ আদেশের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানির পর তা বিক্রি করে দিচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। দু-একটি ঘটনা বন্ড কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়লেও বেশিরভাগ থাকছে আড়ালে। মূলত দুভাবে বন্ডের পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়। প্রথমত, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স খুলে পণ্য আমদানির মাধ্যমে। ২০১৫ সালে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট থেকে এ জাতীয় ৪৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। দ্বিতীয়ত, আমদানি প্রাপ্যতা জালিয়াতি। এ প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাঁচামাল শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করে। মূলত আমদানি প্রাপ্যতা নির্ধারণ পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এ কাজটি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেক প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আদেশ যৎসামান্য থাকলেও শুধু মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী প্রাপ্যতা নির্ধারণ করিয়ে নিচ্ছেন। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করছে অসাধু কর্মকর্তারা। পরে তা খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে অবৈধভাবে পণ্য অপসারণের দায়ে ৯১টি রাজস্ব ফাঁকির মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার পণ্য মূল্য ১৫৭ কোটি টাকা। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ৭১ কোটি টাকা। ঢাকা বন্ড কমিশনারেটে আরও বেশি অবৈধ অপসারণের ঘটনা উদঘাটন করা হয়েছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এক চিঠিতে আমদানি প্রাপ্যতার আদেশ সংশোধনের সুপারিশ করে বলা হয়েছে, আদেশ সংশোধন করা না হলে বন্ডের আওতায় আমদানি করা কাঁচামালের অবৈধ অপসারণ বৃদ্ধির প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হবে। ওই চিঠিতে গোল্ডেন সন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অবৈধভাবে পণ্য অপসারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি একটি অপরাধপ্রবণ প্রতিষ্ঠান। আমদানি প্রাপ্যতা আদেশের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে অবৈধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। বন্ড সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রপ্তানি কমে গেছে। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অথচ রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল আমদানি করেছে আগের মতোই। এটি সন্দেহজনক। কারণ, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে মেশিন ক্যাপাসিটির অনুযায়ী আমদানি প্রাপ্যতা দেওয়া হয়। যদি রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি এত কম হয়, তাহলে আমদানি করা কাঁচামাল যায় কোথায়? নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেন, বন্ডের অপব্যবহারের জন্য আমদানি প্রাপ্যতা নির্ধারণের দুর্বলতা দায়ী। এর সঙ্গে সব পক্ষই জড়িত। লোকবলের অভাব থাকায় অনেক সময় তা মনিটরিং করা যায় না। বন্ডের অপব্যবহার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গেলেই ব্যবসায়ীরা কাস্টমস থেকে অসহযোগিতা করার অভিযোগ তোলে। এদিকে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, বাস্তবে কোনো ধরনের পোশাক কারখানা না থাকার পরও ৪৭৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে আছে বন্ড লাইসেন্স। এসব বন্ড লাইসেন্স ব্যবহার করে পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করেছেন কালোবাজারের সঙ্গে জড়িত অসাধু পোশাক কারখানার মালিকরা।

এমন প্রেক্ষাপটে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার নিয়ে গত ১১ মে একটি বৈঠক ডাকা হলেও প্রভাবশালী মহলের চাপে সেটি স্থগিত করা হয়। ১৫টি এজেন্ডা নিয়ে ওই সভা হওয়ার কথা ছিল। এজেন্ডাগুলোর মধ্যে ছিল, অস্তিত্বহীন বন্ড প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করে হালনাগাদকরণ। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ আইটেমের শুল্কফাঁকি রোধে অনিয়ম পর্যালোচনা করা। ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউস ও পাসবই ইস্যু পর্যালোচনা। কতটি প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা সংশোধন ও যৌক্তিকরণ করা হয়েছে। বকেয়া রাজস্ব আদায় পর্যালোচনা এবং নিরঙ্কুশ বকেয়া আদায়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা ইত্যাদি। জানা গেছে, দেশে এখন মোট ৬ হাজার ৫৬৫ প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স থাকলেও অনিয়মের কারণে ১ হাজার ৭৫৭ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে কাস্টমস। আবার কারখানা বন্ধ থাকার পরও বন্ড লাইসেন্স আছে ২ হাজার ৪৩৮টি পোশাক ও প্যাকেজিং কারখানার। অভিযোগ উঠেছে, দেশে পোশাকশিল্প মালিকদের ফ্রি-স্টাইলে দেওয়া হচ্ছে বন্ড লাইসেন্স। ফলে ভুঁইফোর প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে শত শত বন্ড লাইসেন্স রয়েছে। এসব বন্ড লাইসেন্স দিয়ে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে সরকারের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব লোপাট করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের তথ্যমতে, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলো পুনঃরপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির সুযোগ পায়। বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার আওতায় রপ্তানির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি হয়েছে দিনের পর দিন। ফলে প্রতিবছর শুধু আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়ে থাকে সরকার। প্রসঙ্গত, রপ্তানিতে সহযোগিতা করতে সরকার শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে আমদানির সুযোগ দেয়। অর্থাৎ একটি রপ্তানিমুখী কারখানার উৎপাদনে ব্যবহৃত সব কাঁচামাল কোনো ধরনের শুল্ক না দিয়েই আমদানি করা যায়। এই শুল্কমুক্ত সুবিধা ‘বন্ড সুবিধা’ নামে পরিচিত। বন্ড সুবিধা পাওয়ার অন্যতম শর্ত থাকে, হিসাবমতো কাঁচামাল আমদানি করতে হবে এবং তা খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। আমদানিকৃত শুল্কমুক্ত পণ্য সংশ্লিষ্ট কারখানার বন্ডেড ওয়্যারহাউসে মজুদ রেখে উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে।

সর্বশেষ খবর