শিরোনাম
শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

যত টেস্ট তত বাণিজ্য

মন্ত্রণালয়ের হুমকি-ধমকি, কড়া নোটিস নজরদারি সত্ত্বেও কোনো কাজ হচ্ছে না

সাঈদুর রহমান রিমন

যত টেস্ট তত বাণিজ্য

পটুয়াখালীর দশমিনা পল্লী থেকে আগত রোগী মেরাজ মিয়া বক্ষব্যাধির চিকিৎসা নিতে দালালের হাত ধরে হাজির হন ধানমন্ডির এক পাঁচ তারকা হাসপাতালে। সেখানে কেবিন নিয়ে টানা দুই দিনের ভাড়া বাবদ আট হাজার ৬০০ টাকা পরিশোধের পরই কেবল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে সামনে পান। তিনি মেরাজ মিয়ার মুখে অসুস্থতার বর্ণনা শুনেই প্রেসক্রিপশনের নামে ৯ ধরনের টেস্ট (শারীরিক পরীক্ষা) সংক্রান্ত স্লিপ দিয়ে জরুরিভাবে তা করানোর নির্দেশ দেন। শারীরিক পরীক্ষাগুলো পাঁচ তারকা হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করানোর ব্যাপারেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বিশেষ তাগিদ ছিল। বাধ্য হয়েই মেরাজ মিয়া তড়িঘড়ি ওই হাসপাতালেরই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হাজির হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ৯ ধরনের শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। এ জন্য তার কাছ থেকে ৫২ হাজার টাকা আদায় করা হয়। পরদিন যথারীতি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার টেস্ট রিপোর্টগুলো দেখে ‘বড় ধরনের কোনো অসুস্থতার আশঙ্কা নেই’ বলে মেরাজ মিয়াকে আশ্বস্ত করেন এবং সামান্য কিছু ওষুধ নিয়মিত সেবনের পরামর্শ দিয়ে বিদায় করে দেন। ওই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে মহাখালীর এক আত্মীয়ের বাসায় উঠতে না উঠতেই মেরাজ মিয়ার শারীরিক অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে। রাতে তার অবস্থার চরম অবনতি ঘটায় আতঙ্কিত আত্মীয়স্বজন দ্রুত তাকে গুলশানের অপর একটি অভিজাত হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে আরেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মেরাজ মিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দ্রুততার সঙ্গে আরও সাত ধরনের টেস্ট করার নির্দেশ দেন। এ সময় মেরাজ মিয়ার স্বজনরা এক দিন আগেই সম্পন্নকৃত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাগজপত্রের ফাইল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের হাতে তুলে দিলে তিনি তা ছুড়ে ফেলে দেন। ওই ডাক্তার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ঢাকার অন্য কোনো ল্যাব বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট তিনি বিশ্বাসই করেন না। গুলশানের অভিজাত ওই হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার রিপোর্ট ছাড়া তার দ্বারা রোগী দেখা সম্ভব না বলেও জানিয়ে দেন তিনি। উপায়ন্তরহীন মেরাজ মিয়াকে সেখানকার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে নতুন করে একই ধরনের টেস্ট করানো হয়। এবার তার খরচ হয় ৬৫ হাজার ২৫০ টাকা। পরদিন সেসব টেস্ট রিপোর্ট দেখে মেরাজ মিয়াকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে অন্তত ১০ দিন ভর্তি থেকে জরুরি চিকিৎসা গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেন। বর্তমানে সেখানেই দৈনিক তিন হাজার টাকা বেড ভাড়ায় অবস্থান নিয়ে জটিল রোগের জরুরি চিকিৎসা নিচ্ছেন মেরাজ মিয়া।

জটিল-কঠিন কি সাধারণ—সব রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার নামে এভাবেই চলছে মহা টেস্ট বাণিজ্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হুমকি-ধমকি, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কড়া নোটিস, নজরদারির নানা ঘোষণা সত্ত্বেও ডাক্তারদের টেস্ট বাণিজ্য কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। ‘যত টেস্ট তত টাকা’, এই কমিশন বাণিজ্যের মধ্য দিয়েই চলছে একশ্রেণির ডাক্তারের অর্থ উপার্জনের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। প্রেসক্রিপশনে যত বেশি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার বিষয় উল্লেখ থাকবে, ততই কমিশন পাবেন তিনি। ‘ডাক্তারদের কমিশন ছাড়া সিংহভাগই লাভ’— এ মূলমন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করে যে-কেউ যেখানে-সেখানে ডায়াগনস্টিক বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই দেশজুড়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ব্যবসার ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চলে রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে অহরহ ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ারও অসংখ্য নজির রয়েছে। পুরুষের পরীক্ষা রিপোর্টে তুলে ধরা হয় মেয়েলি রোগের বিবরণ। আবার নারীর পরীক্ষায় পুরুষের রোগের উপস্থিতিও লিখে দেওয়া হয়। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। তা সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্ট বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। অভিযোগ তুলেও এসবের প্রতিকার মিলছে না। ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত স্লিপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার ওই রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। এ সুযোগে কথিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছামাফিক টাকা-পয়সা আদায়ের মনোপলি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

কথায় কথায় টেস্ট : সাধারণ রোগের জন্যও চিকিৎসকেরা বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে রোগীদের পাঠাচ্ছেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখান থেকে তারা পান কমিশনের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। রোগী আকর্ষণের জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় বিশেষজ্ঞদের তালিকার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হলেও তাদের অধিকাংশকেই পাওয়া যায় না। নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেওয়া হয় ওই সব ডাক্তারকে। ডাক্তাররা এখন সামান্য জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। প্রয়োজন না থাকলেও হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করিয়ে ছাড়েন তারা। সুযোগ থাকলে অপারেশনের মুখোমুখি করিয়ে লাইফ সাপোর্টের পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে রোগীকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাক্তারের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন।

যেমন খুশি ফি : বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহে রোগীদের থেকে মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায় কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। খেয়ালখুশিমতো বাড়ানো হচ্ছে সেবা ফি। চিকিৎসার নামে নানা কৌশলে রোগী ও তার স্বজনদের পকেট খালি করেও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ক্ষান্ত হয় না, উপরন্তু রোগীকে বন্দী রেখে বা রোগীর লাশ জিম্মি করেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক রেট চার্ট মানে না রাজধানীর কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নিজস্ব রেট চার্ট। অনেক ক্ষেত্রে টেস্টের টাকা পরিশোধ করে সর্বস্বান্ত হয়ে চিকিৎসা না নিয়েই বাসায় ফিরতে বাধ্য হন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির রোগীরা। আবার বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অতিরিক্ত হিসেবেই হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা। এ টাকার মোটা অংশ হিসেবে কমিশন চলে যায় ডাক্তারদের পকেটে। এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি অজ্ঞাত কারণে বরাবরই চরম উদাসীন। নিয়ন্ত্রণহীন এসব ‘সেবামূল্য’ আদায়ে রোগীদের জিম্মি করাসহ নানা মাত্রার হয়রানি-অত্যাচার সুদখোর মহাজনদেরও হার মানাচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সরকারি একটি রেট চার্ট দেওয়া আছে। ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৮০ ও সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজিতে সর্বনিম্ন ১৫০ ও সর্বোচ্চ এক হাজার ৩০০ টাকা, বায়োকেমিস্ট্রিতে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, হিস্ট্রোপ্যাথলজিতে সর্বনিম্ন ৫০০ ও সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা, ড্রাগ এবিউজে সব ধরনের পরীক্ষা সাড়ে ৫০০ টাকা, থেরাপিউটিক ড্রাগের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ও ভাইরোলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২০০ ও সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়।

মনগড়া রিপোর্ট : সেবার উদ্দেশ্য ছাড়াই নিছক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল। মনগড়া রিপোর্ট তৈরির মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে অহরহ। যেখানে জটিল রোগ নিয়ে মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা, সেখানে অদক্ষ টেকনিশিয়ানের মাধ্যমেই ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে আর ভুলভ্রান্তিও ঘটছে। ফলে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি প্রায়ই রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এই কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে উন্নত চিকিৎসা আর ভালো ব্যবহারের নামে চলছে ‘গলাকাটা বাণিজ্য’। স্বাস্থ্যসেবার নামে গজিয়ে ওঠা বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোতে রোগীদের থেকে মাত্রাতিরিক্ত ‘সেবা ফি’ আদায়ের পাগলা ঘোড়া চলছে তো চলছেই। দিনে দিনে, এমনকি প্রতি ঘণ্টার ব্যবধানে পাল্টে যাচ্ছে চিকিৎসা খরচ। টেস্ট বাণিজ্যের কল্যাণে চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে আকাশ ছুঁতে চলেছে।

ডায়াগনস্টিক এখন প্রতারণা সেন্টার : সরকারি অনুমোদন ছাড়াই দেশজুড়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ব্যবসার ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই। হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। একশ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্ট বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। অহরহ ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন মানুষজন। বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। অভিযোগ উঠেছে, কমিশনের লোভে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভাগটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেওয়া হয় না। এখানে সবচেয়ে দামি দামি আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে দ্রুতই সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি অনুমোদন নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করে না। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোগ নিরাময় কেন্দ্র খুলে বসেছেন। ভুঁইফোড় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি বরাবরই চরম উদাসীন। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও নেয়নি এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রতিনিয়ত রক্ত মিশ্রিত ব্যান্ডেজ, মাংসের টুকরা, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও অন্যান্য আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের আশপাশে, খোলা স্থানে। এ কারণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে র‍্যাব উদ্যোগী হয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। দোষী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিলগালা করাসহ মালিক-কর্মকর্তাদের জরিমানা দণ্ডেরও রায় দেওয়া হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগটির কোনো রকম তত্পরতা দেখতে পাওয়া যায় না।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর