রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিকিৎসা ব্যয় কেন আকাশছোঁয়া

পাঁচ তারকা হাসপাতালের টেস্ট ব্যাণিজ্য, স্বাস্থ্য সেবা, ডাক্তারের ফি, ওষুধ সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যয় আকাশচুম্বী। এক্ষেত্রে ভারতের দিল্লি, চেন্নাই, কলকাতায় বাংলাদেশের চেয়ে চিকিৎসা ব্যয় কম। এমনকি চিকিৎসা সেবা নিতে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরের মতই ব্যয় হয় বাংলাদেশে। সরকারি হাসপাতালে মেলে না চিকিৎসা সেবা, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় গলা কাটা মূল্য। এরপরেও সঠিক চিকিৎসা মেলে না কোথাও। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের প্রতিবেদকরা

 

অভিযোগ সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়

—ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন

দেশে চিকিৎসাসেবার নামে টেস্টবাণিজ্য ও রোগীর গলা কাটা হচ্ছে— এমন অভিযোগ মানতে নারাজ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞান টেস্টনির্ভর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগ চিহ্নিত করার জন্য টেস্ট করা লাগে। চিকিৎসার অগ্রগতি দেখার জন্যও টেস্ট করা লাগে। সে কারণে রোগীর বেশি টাকা খরচ হতে পারে। তার মানে এই নয় যে, রোগীর গলা কাটা হচ্ছে। তবে দু-একটি হাসপাতাল ও কিছু ডাক্তার যে বেশি ফি নিচ্ছেন না ও অতিরিক্ত টেস্ট করা হচ্ছে না তাও মিথ্যা নয়। কিন্তু এর সংখ্যা খুবই কম। কাজেই এমন অভিযোগ সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।’ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘উপজেলায় অনেক রোগী আসেন যাদের কোনো টেস্ট করা দরকার হয় না; কিন্তু তারা ডাক্তারের সঙ্গে তর্ক করেন, টেস্ট না করে আমাকে কী চিকিৎসা দিতেছেন?’ ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে আগ্রহী— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডাক্তারদের সরকারি হাসপাতালে যতক্ষণ ডিউটি ততক্ষণ সঠিকভাবেই পালন করেন। দায়িত্ব শেষ করে তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেই পারেন এবং করবেন এটাই স্বাভাবিক। দেখতে হবে তারা হাসপাতালের ডিউটি বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকে বসেছেন কিনা।’ সরকারি হাসপাতালে সেবা মেলে না, পাঁচ তারকা হাসপাতালে রোগীর গলা কাটা হয়— এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে বিএমএ সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে সেবা মেলে না কথাটি ঠিক নয়। কারণ ঢাকা মেডিকেল কলেজ সরকারি হাসপাতাল। সেখানে সঠিকভাবেই সেবা দেওয়া হয়। অনুরূপ সোহরাওয়ার্দী ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও সরকারি। সেখানেও মানুষ সঠিক সেবা পাচ্ছে। আর পাঁচ তারকা হাসপাতালে গলা কাটার অভিযোগ আমার কাছে নেই।’ তবে বিশ্বমানের সেবা পেতে হলে মানুষকে কিছুটা বাড়তি টাকা গুনতে হবেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চিকিৎসার ব্যয়ে আমাদের দেশে পার্থক্য থাকবেই।’

 

সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন

—ড. ইফতেখারুজ্জামান

দেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সেবা পায় না মানুষ। আর অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল সেবার নামে করছে বাণিজ্য। তাই মানুষের সঠিক স্বাস্থ্যসেবা    নিশ্চিত করতে সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে নীতিমালা তৈরি করতে হবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের বাজেট একেবারেই কম। তাই প্রত্যাশিত সেবা পায় না মানুষ। আর এ সুযোগে ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব হাসপাতালের বিল আর ওষুধের খরচ জোগাতে নিঃস্ব হতে হয় সাধারণ মানুষকে। চিকিৎসকদের বিরাট একটা অংশ এটা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। চিকিৎসাকে সেবা হিসেবে না নিয়ে ব্যবসা হিসেবে দেখছেন এই অসুস্থ মানসিকতার চিকিৎসক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। স্বাস্থ্য খাতে বর্তমানে বিরাজ করছে দায়সারা অবস্থা। আর এ সেবা ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে আছে প্রভাবশালী মহল। তাই যে নিয়মনীতিগুলো আছে সেগুলোও মানার প্রয়োজন পড়ে না এ হাসপাতাল মালিকদের। সুস্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতকে নীতিমালায় এনে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের মতামতের ভিত্তিতে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে তা থেকে আইন তৈরির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। নিয়ন্ত্রণ, পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে এনে স্বাস্থ্য খাতের এ বিশৃঙ্খলা পরিবর্তন করতে হবে।

 

শুভঙ্করের ফাঁকি বন্ধ করতে হবে

—ড. জিনাত হুদা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, ‘অনেক চিকিৎসক রয়েছেন যারা টেস্ট করার জন্য প্যাথলজি নির্ধারণ করে দেন। এই টেস্ট রিপোর্ট অন্য চিকিৎসককে দিলে তারা আবার আরেক জায়গায় করানোর পরামর্শ দেন। মানুষের সেবার দিকে নজর নেই, তারা আছেন শুধু ব্যবসা নিয়ে। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এই শুভঙ্করের ফাঁকি বন্ধ করতে হবে।’ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি।

জিনাত হুদা আরও বলেন, ‘এ দেশের প্যাথলজিতে যে রিপোর্ট দেওয়া হয় তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এখানকার টেস্টে দেখা যায় কিছুই ধরা পড়েনি অথবা অনেক কিছু ধরা পড়েছে। অথচ দেশের বাইরে গিয়ে টেস্ট করালে দেখা যায় রোগীর শরীরে ওই ধরনের সমস্যা নেই। মানুষের জীবন নিয়ে লুকোচুরি বা ব্যবসা করার সুযোগ নেই। সরকারি হাসপাতাল মুমূর্ষু রোগীর জন্য বিছানাও মেলে না। আর প্রাইভেট হাসপাতালের বিল আসে গলা কাটা। এ বিল পরিশোধ করার সাধ্য আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের নেই। মানুষ চিকিৎসকের ওপর ভরসা করে জীবন বাঁচাতে তার কাছে যায়। কিন্তু কিছু চিকিৎসক যখন মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে ব্যবসায় মেতে ওঠেন তখন কষ্ট হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে তরুণরা চিকিৎসা পেশায় আসছেন তাদের মনস্তাত্ত্বিক জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে অন্য পেশার মতো চিকিৎসা নয়, এটা সেবা। চিকিৎসকদের রোগী দেখার ফি একটা নির্ধারিত সীমার মধ্যে আনতে হবে। যেসব ভুঁইফোড় প্যাথলজি আছে সরকারকে এদের নির্দিষ্ট মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি সেবার নামে যারা প্রতারণা করছে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’

 

চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেকেই গরিব

—ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু

প্যাশেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু বলেছেন, ‘চিকিৎসার প্রতিটি ধাপে রোগীদের চড়া মূল্য দিয়ে সেবা নিতে হচ্ছে।

অনেক রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে গরিবও হয়ে পড়ছেন। চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অনেক রোগীই বেসরকারি হাসপাতালে যেতে ভয় পান। আবার যথাযথ সেবা না পাওয়ায় সরকারি হাসপাতালেও রোগীরা যেতে চান না।’ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

এই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ছয় কারণে চিকিৎসাসেবায় ব্যয় বাড়ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) বিভিন্ন পদের ডাক্তারদের ফি নির্ধারণ করে না দেওয়ায় চিকিৎসরা যে-যার মতো রোগীর কাছ থেকে ফি আদায় করছেন। বর্তমানে এমনও দেখা যাচ্ছে একজন অধ্যাপকের চেয়ে সহকারী অধ্যাপক রোগীর কাছ থেকে বেশি ফি নিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘লাগামহীন কমিশন বাণিজ্যের করণেই অপ্রয়োজনীয় টেস্ট রোগীদের ধরিয়ে দিচ্ছেন অনেক ডাক্তার। এ ছাড়া টেস্টের যা মূল্য হওয়া উচিত তার চেয়েও দুই থেকে তিন গুণ বেশি টাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো রোগীদের কাছ থেকে নিচ্ছে।’

প্যাশেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘ওষুধের মূল্য বেশি হওয়ায়ও চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, কাঁচামাল, তৈরি খরচসহ ওষুধের যে মূল্য হওয়ার কথা তার চেয়েও ৩০-৪০ গুণ বেশি মূল্যে রোগীকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। এতে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অনেক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে বেড ভাড়ার জন্য অতিরিক্ত মূল্যও রোগীকে গুনতে হয়। বিশেষ করে আইসিইউ ও সিসিইউতে মাত্রাতিরিক্ত বেড ভাড়া দিতে হয় রোগীকে। এ ছাড়া লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীর চিকিৎসা ব্যয় অনেক গুণ বেড়ে যায়। ইদানীং আইসিইউ ও সিসিইউতে অনভিজ্ঞ চিকিৎসকের অপচিকিৎসার কারণেও রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।’ এই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় সরকারি হাসপাতালের চেয়ে অপারেশন চার্জ বেশি হওয়ায় রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। বিকল্প চিকিৎসার নামে ভুল তথ্য প্রচার করে অপচিকিৎসার ফাঁদে ফেলে রোগীকে সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে। এতে রোগী চিকিৎসকের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্য দেশে চিকিৎসা করতে যান।’

সর্বশেষ খবর