সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট

যুদ্ধের আবহ সৃষ্টির পক্ষে বিএনপিপন্থি বিশিষ্টজনরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার ইস্যুতে গোলটেবিল বৈঠকে কূটনীতিক ও বিশিষ্টজনরা বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বহির্বিশ্বকে পাশে পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই সামরিক শক্তি দেখাতে হবে। মিয়ানমারকে সমস্যা সমাধানে বাধ্য করতে হলে কিছুটা যুদ্ধের আবহ সৃষ্টি করতেই হবে। কারণ আজকের বৈশ্বিক রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শত কান্নাকাটি করেও কিছু হবে না, যদি না নিজস্ব শক্তি দেখানো যায়। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করার দরকার নেই, কিন্তু অবশ্যই নিজস্ব ক্ষমতার প্রদর্শন করতে হবে। তবেই বিশ্বের অন্য দেশগুলোকেও বাংলাদেশের পাশে পাওয়া যাবে। গতকাল বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে ‘মিয়ানমারে গণহত্যা ও বাংলাদেশের ভূমিকা’ শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে  বৈঠকে স্পেন, ফ্রান্স, ইরান, সৌদি আরব, ডেনমার্ক, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, মালদ্বীপ, জাপান ও কুয়েতের কূটনীতিক এবং জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ১২টি দেশ ও দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কূটনীতিকবৃন্দ এবং দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এতে অংশ নেন। তবে বৈঠকে চীন, ভারত এবং রাশিয়ার কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এম সেরাজুল ইসলাম।

বক্তারা বলেন, মিয়ানমারের সৃষ্ট এ সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। তাদের বাংলাদেশে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে এবং নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব দিয়ে নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে এজন্য আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও চাপ সৃষ্টি করতে হবে দেশটির ওপর। প্রয়োজনে বিভিন্ন রকমের অবরোধ প্রয়োগ করতে হবে।

সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহর পরিচালনায় বৈঠকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলারা জামান, অর্থনীতিবিদ মাহবুবউল্লাহ, কবি আবদুল হাই শিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আকতার হোসেন, অধ্যাপক সদরুল আমিন প্রমুখ অংশ নেন। আয়োজক সংগঠনের পক্ষ থেকে ছিলেন— দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার  মোশাররফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, মজিবর রহমান সারোয়ার, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন, শামা ওবায়েদ রিংকু, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকাও তাদের দ্বিধান্বিত ও বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। এটি জাতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে সরকারের কিছু ব্যর্থতা ছিল। সেই জন্য এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে জাতিসংঘ এবং কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।

আসিফ নজরুল বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে চোখ রেখে নিজস্ব শক্তি প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকারকে বৈশ্বির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অনুধাবন করে রাষ্ট্রের নিজস্ব শক্তি দেখাতে হবে। আজকে বৈশ্বিক রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে শত কান্নাকাটি করে কিছু হবে না, শক্তি দেখাতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে এমন নয়। তবে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বারবার আমার দেশের সীমারেখায় ঢুকে পড়বে, আর আমরা কিছুই বলব না, এটা হতে পারে না। হেলিকপ্টার ভূপাতিত না করলেও গুলি করতে হবে। বোঝাতে হবে আমাদের ক্ষমতা। সবকিছুতেই ভীত হয়ে নরম হলে সবাই পেয়ে বসবে। এখন রোহিঙ্গাদের পাঠানো হচ্ছে, পরবর্তীদের অবৈধ বাংলাদেশি অজুহাতে অন্য প্রতিবেশীরাও অনুপ্রবেশ ঘটাবে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেউ নোবেল পুরস্কার পেলে সেটি ভালো। কিন্তু সেটি সমস্যার সমাধান নয়। এ সরকার বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে দুর্বল করে ফেলছে। অতীতে রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তৎকালীন সরকারগুলো যে সফলতা  দেখিয়েছে সেই অভিজ্ঞতা নিতে হবে। মাহমুদুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য গভীরতম সংকট। অল্প বা মোটামুটি দীর্ঘ সময়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সরকার বলতে পারছে না, ঠিক কতদিনের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে। এর মধ্যে নির্বাচন চলে এলে অনেক রকম খেলা শুরু হবে। বাংলাদেশে  থেকে যাওয়া আগের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিতে সরকার দলীয় স্থানীয় এমপি আবদুর রহমান বদি সহায়তা করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

 বদি সম্পর্কে মান্না আরও বলেন, ওইখানে একটা নেতা আছে, যিনি বিভিন্ন চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্যে খবর এসেছে তিনি অনেক রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্তত চার লাখ রোহিঙ্গাকে যদি জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয় তবে ভোটে সেটি অনেক প্রভাব ফেলবে। অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ভারত ও চীনের অবস্থান বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের বিকল্প নেই। ভারত ও চীনকে অবশ্যই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলকে ধন্যবাদ যে, তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মাহমুদ হাসান বলেন, সংকট সমাধানে কফি আনানের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে অবশ্যই মিয়ানমার সরকারকে তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, রোহিঙ্গারা এদেশে দীর্ঘদিন অবস্থান করলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সের মা-বাবাহীন রোহিঙ্গা শিশুদের পুনর্বাসন করতে না পারলে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

 যেহেতু তারা লেখাপড়ার সুযোগ পাবে না, ফলে তারা যে কোনো অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ তাদের বাবা-মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিশোধ স্পৃহা রয়েছে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের জন্য বিএনপিকে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি করে চীন, ভারত, রাশিয়াসহ বহির্বিশ্বে মিশনে নামতে হবে। সরকার বিএনপির সঙ্গে না এলেও পৃথকভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি।

 এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম ও পুস্তিকা করার পরামর্শ দেন এবং সব ভাষায় তা অনুবাদের পরামর্শ দেন ড. মাহবুব উল্লাহ।

সর্বশেষ খবর