রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিষ্ঠুরতার শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড

ধর্ষণ, শিশু-কিশোর নির্যাতন ও নির্মম হত্যার দ্রুত কঠোর বিচার চায় সাধারণ মানুষ

জিন্নাতুন নূর

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারী-শিশুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। যৌন হয়রানি, শিশুর ওপর শারীরিক নির্যাতন, জনসম্মুখে পিটিয়ে হত্যার মতো অপরাধগুলো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চোখের সামনে একটি শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করতে দেখলেও মানুষ এর প্রতিবাদ করছে না।

অর্থাৎ সাধারণ মানুষ এক ধরনের ‘সামাজিক রোগে’ আক্রান্ত। দেশে চলমান ভয়াবহ সামাজিক সহিংতা বিষয়ে কথা হলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরাধীদের রুখতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সঙ্গে সামাজিকভাবেও চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এ ধরনের অপরাধীদের নিয়ে রিসার্চ সেল গঠন করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অপরাধীদের জন্য সংশোধনমূলক কার্যক্রমও গ্রহণ করতে হবে। অপরাধীদের মনে ভয় তৈরি করতে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করে সেই অপরাধীর ছবি ও অপরাধের ধরন জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। সমাজের উন্নয়নে সামজবিজ্ঞানী ও আলেমদের একত্রে কাজ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা এখন ‘‘এ প্লাস’’ পাওয়ার শিক্ষা নিচ্ছে কিন্তু মানবিক শিক্ষা পাচ্ছে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানবিক নয়। অথচ উন্নত বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সততা ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিচ্ছে, যা আমাদের এখানে হচ্ছে না। আর মানবিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় সমাজে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে অপরাধীদের ফাঁসি দিতে হবে। তবে ফাঁসি অপরাধ কমালেও সন্তান হারানো অভিভাবকদের ক্ষতি পূরণ করতে পারবে না। এ জন্য সমাজে এ ধরনের অপরাধ যাতে আর না ঘটে তা নিশ্চিত করতে অপরাধীদের সংশোধনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. হেদায়েতুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণত যেসব মানুষের মধ্যে অ্যাগ্রেসিভ টেনডেন্সি বেশি থাকে, তারা কোনো কিছু চিন্তা না করেই আরেকজনের ক্ষতি করে বসে, যা কিছু ক্ষেত্রে গণধর্ষণের জন্য কিশোরদের উসকানি দেয়। যারা নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন করে, তারা পারসোনালিটি কনফ্লিক্টের শিকার। এ ধরনের মানুষ অন্যের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা বেশি করে। অর্থনৈতিক কারণ, মাদক গ্রহণ, ইন্টার পারসোনালিটি কনফ্লিক্ট এবং মানসিক সমস্যা থেকে অপরাধীরা নারী ও শিশুদের নির্যাতন করে। বিভিন্ন নাটক ও চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত হত্যা ও ধর্ষণের দৃশ্য অপরাধীদের অপরাধ করতে আরও উসকে দিচ্ছে। এসব অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। তবে এর আগে এই অপরাধীদের মানসিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। মানুষ এখন তার সামনে হত্যার দৃশ্য দেখেও প্রতিবাদ করে না। কারণ দেশ ‘সামাজিক রোগে’ আক্রান্ত।

জামায়াতুল উলামার সভাপতি ও শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নারী-শিশু নির্যাতনকারীদের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের শাস্তির বিধান রাখা না হলে তারা আরও বেপরোয়া আচরণ করবে। মানবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পারিবারিক আবহ ও নৈতিক শিক্ষা। সমস্যা হচ্ছে, এখন অপরাধ সংঘটিত হলে তা থামানোর পরিবর্তে প্রত্যক্ষদর্শীরা এর ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সামাজিক এই অবক্ষয় শুধু আইন প্রয়োগ করে বন্ধ করা যাবে না। এ জন্য পারিবারিক দায়বদ্ধতাও প্রয়োজন। সমাজের উন্নয়নে সমাজবিজ্ঞানীসহ আলেমদের একত্রে কাজ করতে হবে। শুধু কয়েকজন অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে গোটা সমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, যে অপরাধীরা এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, তারা নিজেদের অপরাধ সম্পর্কে অজ্ঞ। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে একযোগে বড় স্ক্রিনে এসব অপরাধের জন্য যে শাস্তির বিধান আছে তা প্রচার করতে হবে। বিশেষ করে গ্রামের হাটবাজার ও জনসমাগম বেশি হয় এমন স্থানে এগুলো প্রচার করতে হবে। এ ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে কিছু মামলায় মৃত্যুদণ্ড নাও হতে পারে। আর নারী-শিশু নির্যাতনকারীসহ যারা জনসম্মুখে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করে সেই ছবি সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে। কোনো একটি নির্যাতনের ঘটনা দেখেও যারা প্রতিবাদ করে না, তাদের ভয় ভাঙাতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের বিরাট ধস নামায় কোনো মানুষকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করলেও এখন অন্য মানুষেরা তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে না। সমাজে শিশুরা শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে। আর এ জন্য তাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করা হয়। আকাশ-সংস্কৃতির মাধ্যমে নির্যাতনের পৈশাচিক বিষয়গুলো উচ্চবিত্ত থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। যে ধরনের নির্যাতনের কথা আগে কখনো চিন্তা করা হয়নি তা এখন ঘটতে দেখা যাচ্ছে। শিশুদের পিটিয়ে হত্যা করার মতো ঘটনায় কঠোর শাস্তি হিসেবে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অপরাধের মাত্রা হয়তো কমিয়ে আনা সম্ভব, কিন্তু এর মাধ্যমে জঘন্য এই অপরাধের মূলোৎপাটন করা যাবে না। প্রধান শাস্তি হিসেবে এসব অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ছাড়াও তাদের সামাজিকভাবে চাপে রাখতে হবে। এ ছাড়া এমন অপরাধীদের জন্য একটি রিসার্চ সেল গঠন করার সময় এসেছে। সে কেন এবং কীভাবে অপরাধ করেছে, তার কোনো মানসিক সমস্যা আছে কি না, এগুলো চিহ্নিত করে সেই সেলে তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে অপরাধীকে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার আগে তাকে একবার সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সমাজে যারা নারী ও শিশুদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর এই অপরাধীদের গ্রেফতারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না তাদের দায়িত্বশীল করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। মূলত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ার জন্যই অপরাধীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সমাজে সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দেশের চলমান আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অবশ্যই দিতে হবে। অপরাধ করে যে পার পাওয়া যায় না এই বার্তা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে প্রভাবমুক্ত হতে হবে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মানুষ তার চোখের সামনে সহিংস ঘটনাগুলো দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। অপরাধ ঘটতে দেখলেও তাদের মধ্যে প্রতিবাদ করার মনোভাব তৈরি হচ্ছে না। এ জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

‘নিজেরা করি’ সংগঠনের সমন্বয়কারী, নারীনেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর বলেন, ‘শিশুদের ওপর যেভাবে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তা থেকে এটি বোঝা যায় যে শাসনব্যবস্থায় কোথাও কোনো সমস্যা আছে। আমাদের প্রচলিত নীতিমালাগুলো যাতে যথাযথভাবে চলে তা নজরদারি করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আইন ভাঙা হচ্ছে কি না তা রক্ষার দায়িত্ব তাদেরই। কিন্তু আইনের রক্ষকরাই এখন আইন ভাঙছেন। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে, অপরাধীরা এখানে অপরাধ করেও ধরা পড়ছে না। আর ধরা পড়লেও তাদের ওপর আইন কার্যকর করা হয় না। অথচ উন্নত দেশগুলোতে কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তার খারাপ কাজের জন্য তাকে সমাজ বয়কট করে। আমাদের সমাজেও একই ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।’

সর্বশেষ খবর