শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সবাই এখন চালায় ড্রোন

নাটক সিনেমা এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠান বানাতেও ব্যবহার হচ্ছে মনুষ্যবিহীন এ উড়োযান

জিন্নাতুন নূর

সবাই এখন চালায় ড্রোন

মিরপুর দিয়াবাড়ী এলাকায় সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একদল শিক্ষার্থী গিয়েছিলেন কাশফুলের ভিডিও করতে। তাদের হাতে থাকা রিমোট কন্ট্রোল ও মাটি থেকে বেশ কয়েক ফুট ওপরে ভাসমান একটি বস্তু দেখে আশপাশের উত্সুক মানুষ ভিড় জমান। তারা জানতে পান যে শূন্যে ভাসমান বস্তুটির নাম ড্রোন (মনুষ্যবিহীন উড়োযান)। সেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই এই ড্রোন ওড়াচ্ছেন। এমনকি ঢাকার বাইরে ঘুরতে গেলে তারা প্রায়ই ড্রোন ব্যবহার করে ভিডিও করেন। তাদের ভাষ্যে ড্রোন ব্যবহার করা এখন ‘ট্রেন্ড’।

জানা যায়, নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে অনুমতি নিয়ে ড্রোন ব্যবহার করা যায়। কিন্তু অনেকেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যত্রতত্র ড্রোন ব্যবহার করছেন। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। সাধারণত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা কর্তৃক শর্তসাপেক্ষে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারের (এমআই-১৭) সিমুলেটর প্রস্তুত কাজে ড্রোন ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী অভিযানে সন্ত্রাসীরাও অপরাধ করার কাজে ড্রোন ব্যবহার করে। তার মানে, যে আশঙ্কা থেকে দেশে ড্রোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা ঠিকই ঘটছে। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সূত্রে জানা যায়, কিছু দিন আগে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার মসিন্দা গ্রামে জেএমবির দুজন সদস্যকে আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্রসহ একটি ড্রোন পাওয়া যায়। এর আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কর্তৃক আটক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে ড্রোন ব্যবহার করে নাশকতার পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া যায়। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও বাড়ছে ড্রোনের ব্যবহার। বিশেষ করে বিভিন্ন নাট্য নির্মাতা ও পরিচালক নাটক ও বিজ্ঞাপন কাজেও ড্রোনের অবাধ ব্যবহার করছেন। এমনকি বাংলাদেশে ঘুরতে আসা কিছু বিদেশি পর্যটকও কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই নিজেদের ভ্রমণ ব্লগের জন্য ড্রোন ব্যবহার করছেন। এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন গায়ে হলুদ বা বিয়ের অনুষ্ঠান ভিডিও করতেও এখন ড্রোনের ব্যবহার হচ্ছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানায়, দেশের আকাশসীমায় ড্রোন ওড়াতে হলে দেড় মাস আগে তাদের অনুমতি নিতে হবে। আর কেউ নির্দেশনা না মানলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা যায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছবি তোলা ও গবেষণা কাজের জন্য ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নীতিমালা, ২০১৩ অনুসারে বিশেষ শ্রেণির সংস্থাগুলোকে (বঙ্গভবন, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) নো ফ্লাইং জোন ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বাহিনী সব স্পর্শকাতর স্থাপনায় ড্রোনের সাহায্যে আকস্মিক বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা থেকে ড্রোন ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বিনা অনুমতিতে দেশের আকাশে ড্রোন উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করে বেবিচক। আর যেসব স্থানে বিমানবন্দর নেই সেখানে বেবিচক ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে তবেই ড্রোন ব্যবহার করা যাবে। এরই মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বেশ কিছু অবৈধ ড্রোন আটক করা হয়। বর্তমানে ড্রোন ওড়াতে বেবিচকের একটি নীতিমালা থাকলেও এসব যন্ত্র আমদানি, উৎপাদন, বিপণন ও নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ড্রোনের ব্যবহার উন্মুক্ত করা উচিত নয়। ড্রোন দুই ধরনের হয়। একটি খেলার উপযোগী, এর মাধ্যমে ক্ষতির ঝুঁকি নেই। আরেকটি আছে তার ওজন বহনের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে এটি লক্ষ্যবস্তুতে কী পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ড্রোন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা দেশের প্রযুক্তিবিদদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। ড্রোনের ব্যবহারে নিরাপত্তা ঝুঁকি অবশ্যই থেকে যায়। এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আর ড্রোন কারা এবং কী কাজে ব্যবহার করছে নজরদারি থাকা উচিত। নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারকারীরা লাইন্সেসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ড্রোন নিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।’ বাংলাদেশে ড্রোন ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি হওয়ার পথে। এরই মধ্যে ড্রোন আমদানি, উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে পুলিশ সদর দফতর। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ড্রোন উড্ডয়নে ঝুঁকির কথা বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় তারা। কারণ দূর নিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন ড্রোন নিঃশব্দে প্রায় ৪০০ ফুট বা ৪০ তলা ভবনের সমান উচ্চতায় উড্ডয়ন করতে পারে। আর ৫ কিলোমিটার দূর থেকেও এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ড্রোন জননিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া ড্রোনের সঙ্গে সংযোজিত ডিভাইস ব্যবহার করে জঙ্গি হামলার জন্য রেকি বা অভিযানও পরিচালনার সুযোগ থাকে। রাজধানীতে বেশ কিছু মার্কেটে যেখানে প্রযুক্তিপণ্য বিক্রি হয় সেখানে ড্রোন বিক্রি হচ্ছে। আবার কেউ কেউ দেশের বাইরে থেকে খেলনা সামগ্রীর নাম দিয়ে ড্রোন আমদানি করছে। বাংলাদেশের অনেক অনলাইন শপেও এখন ড্রোন বিক্রি করা হচ্ছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিকে ড্রোন তৈরি হচ্ছে। আছে ইতিবাচক ব্যবহারও : দেশে ড্রোনের ইতিবাচক ব্যবহারও করা হচ্ছে। যেমন ড্রোনের সাহায্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ তদারকি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তীব্র স্রোতের কারণে মাঝ নদীতে নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণ কঠিন হওয়ায় ড্রোনের সাহায্যে কাজ তদারকি করা হয়। এ ছাড়া সিলেটের আতিয়া মহলের জঙ্গি আস্তানা ছাড়াও মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে বিস্ফোরক দ্রব্য শনাক্তে ড্রোন ব্যবহার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। কৃষিকাজে বর্তমানে ড্রোনের ইতিবাচক ব্যবহার হচ্ছে। আবার ক্যামেরাযুক্ত ড্রোনের সাহায্যে ভূ-জরিপ কাজ, গবেষণামূলক কাজও করা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর