রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রানার সাম্রাজ্যে মেয়র শহীদের শাসন

ভূমি-বিদ্যুৎ-খাদ্য অফিস, থানা, সরকারি হাসপাতালসহ সবখানেই তার প্রভাব

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) থেকে ফিরে

রানার সাম্রাজ্যে মেয়র শহীদের শাসন

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি লড়াই হয় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায়। সে জন্য স্মরণীয় এই জনপদ কালক্রমে শাপগ্রস্ত হয়ে সন্ত্রাসের গডফাদারদের সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। এ পর্যায়ে ঘাটাইল হয়ে পড়েছিল টাঙ্গাইল জেলার সন্ত্রাসের রাজা আমানুর রহমান খান রানার সাম্রাজ্য। মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা মামলায় সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা এখন কারাগারে। স্থানীয়রা বলেন, ফাঁকা মাঠ পেয়ে এখন ‘ঘাটাইলের শাহেনশাহ’ হয়ে ওঠেন পৌর মেয়র শহীদুজ্জামান শহীদ। মেয়র নির্বাচনের আগে মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতনে একটি এনজিওর মাঠকর্মী ছিলেন শহীদ। প্রার্থী হওয়ার পর নির্বাচনের পোস্টার ছাপানোর টাকাও ছিল না তার। ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগ তার জন্য পোস্টার ছাপিয়ে দেয়। সেই পোস্টার হাতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি বলতেন, ‘আমার কিছুই নেই আমাকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন। আমি জনসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করব।’ ক্ষুব্ধ ভোটাররা এখন বলছেন লোকটা বিনয়ী ছিল দেখে মনে হতো অতি সরল। ২০১৬ সালের ৭ আগস্ট মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার ভাবভঙ্গি আচরণ রাতারাতি পাল্টে যায়। দিন দিন স্বেচ্চাচারের মাত্রা বাড়াতে থাকে। নানা ধরনের বাহিনী তৈরি করে নিজের শাসন চালাতে থাকে।

ঘাটাইলে আওয়ামী লীগের তেজস্বী কোনো নেতা না থাকার সুযোগে শহীদের উত্থান শুরু হয়। এখন এমন কোনো খাত নেই যেখানে শহীদ তার বাহিনীর লোকদের দিয়ে চাঁদাবাজি করছেন না। উপজেলা ভূমি অফিস, বিদ্যুৎ অফিস, খাদ্য অফিস, থানা, সরকারি হাসপাতাল সর্বত্রই চলছে শহীদের শাসন। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা শহীদের হুকুম না মানলে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গালাগাল, অন্যত্র বদলির হুমকি, খতম করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি ইত্যাদি শহীদ বাহিনীর কাছে পান্তাভাতের মতো স্বাভাবিক। মেয়রের সন্ত্রাসী বাহিনীর নানা ধরন। দখল বাহিনী, দরবার বাহিনী, চাঁদা বাহিনী, ম্যানেজ বাহিনী কত কী। শহীদ মেয়র হওয়ার পর তার নিজ দলের ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতারা নানাভাবে হচ্ছেন বঞ্চিত। উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পৌর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন ইউনিট আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মেয়র শহীদের আশপাশে ভিড়তে দেওয়া হয় না। তার সন্ত্রাসী বাহিনী বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিচ্ছে। এলাকাবাসী বলেন, মেয়র সাহেব এখন নিজের দলকে চেনেন না। তার চারপাশে জড়ো হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের লোক। উপজেলা আওয়ামী লীগের এক কর্মী বলেন, মেয়র সাহেবের প্রধান উপদেষ্টা হলেন, শিবির নেতা শোভনলাল। এই ব্যক্তি এক সময় ঘাটাইল জিবিজি কলেজের শিবির থেকে ভিপি পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। শোভনের বাবা শেরপুর জেলা জামায়াতের সাবেক আমির। মেয়রের বাহিনীর অন্যতম সদস্য বিএনপির সাবেক প্যানেল মেয়র হাবিবুর রহমান, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইখলাস হোসেন শামীম, পৌর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, উপজেলা যুবদল সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত হোসেন শামীমসহ ১০-১২ জন বিএনপি-জামায়াতের নেতা। পৌরবাসীদের অভিযোগ, মেয়র শহীদুজ্জামান শহীদ বলেছিলেন জনসেবা করবেন। কিন্তু তিনি অবিরাম করে চলেছেন নিজের সেবা। বাস করতেন ভাঙা টিনের ঘরে। এখন বাড়িতে তুলেছেন সুদৃশ্য দালান। পৌর এলাকার উন্নয়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে তার কাজ অত্যন্ত নিম্নমানের। উন্নয়ন কাজের লাখ লাখ টাকা তিনি ও তার বাহিনীর লোকেরা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয় পৌর এলাকায় কেউ বাড়ি-ঘর নির্মাণ করলে তাকে ‘নগদ নজরানা’ দিতে হয়।  রিকশাচালক ফরিদ বলেন, ভাই আমরা গরিব মানুষ। রিকশা চালিয়ে খাই। কিন্তু রিকশা নিয়ে বের হলেই দিতে হয় চাঁদা। আর এই চাঁদা নাকি মেয়র শহীদ নেন। একই কথা বললেন অটোচালক মানিক। তিনি বলেন, কামাই হোক আর না হোক মেয়র সাহেবকে চাঁদা দিতেই হয়। ঘাটাইল বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সফুর আলী বলেন, পৌরবাসীর ভাগ্য বদল না হলেও মেয়রের ভাগ্য বদল হয়েছে। দোয়া করি আরও আল্লায় ওনারে আরও টাকার মালিক করুক।  উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, মেয়র শহীদের সবচেয়ে বড় গুণ তিনি খুব গুছিয়ে অসত্য কথা বলতে পারেন। এ ব্যাপারে তার সমকক্ষ কেউ আছে বলে মনে হয় না। পিডিবির এক কর্মচারী জানান, মেয়র শহীদের রোষানল থেকে রেহাই পাননি পিডিবির প্রকৌশলী সুরেশ চন্দ্র পাল। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহীদ তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে পিডিবি অফিসে গিয়ে ওই প্রকৌশলীকে কিল, ঘুষি মেরেছেন। এ ব্যাপারে থানায় একটি মামলাও হয়েছে। মামলা বিচারাধীন। পৌর এলাকার ঝড়কা বাজারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ৩০০ দোকান বসায় স্থানীয়রা। শাহেনশাহ শহীদের নজর পড়ে ওসব দোকানে। তিনি বলেন এই ৩০০ দোকান উচ্ছেদ করা হবে। কারণ এখানে ছয়তলা ভবন করবে পৌরসভা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিলাপ শুরু হয়ে যায়। তখন মেয়র ঘোষণা করেন দোকানপ্রতি প্রতি মাসে তাকে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা মেয়রের শর্ত মেনে নেন।

পৌরবাসী বলেন, মেয়র নির্বাচিত হয়েই শহীদ সব বাসা-বাড়ি, দোকান ও প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেন। ট্যাক্স দ্বিগুণ হয়েছে, উন্নয়ন মোটেই হয়নি। পৌর এলাকায় লাইটিং করার নামেও নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন। স্কুলের সামনে সৌরবিদ্যুতের ল্যাম্প না বসিয়ে নিজের বাড়ির গেটে বসিয়েছেন। ঘটনাটি এলাকায় ছিঃ ছিঃ রব তুলেছিল।

নিয়োগ বাণিজ্যেও শহীদ দক্ষ বলে শোনা যায়। তার সমালোচকরা বলছেন, কুড়িপাড়া হাইস্কুলে শিক্ষক নিয়োগে ১৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মেয়র। নারী কেলেঙ্কারিতেও তিনি জড়িত বলে রটনা আছে। জনরব এই যে, মাখন নামে বিএনপির এক নেতার সুন্দরী স্ত্রীকে বশীভূত করে নিজের একটি আস্তানায় উঠিয়েছেন মেয়র। ধলাপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হেকমত সিকদার বলেন, মেয়র হওয়ার আগে আমার পিছে পিছে ঘুরত। মেয়র হয়ে আমাকে চিনে না। সে এখন ‘দ্বিতীয় রানা’ হয়ে নানারকম অনাচার করছে। এমনকি গ্রামে গ্রামে গিয়ে চুক্তিভিত্তিক (টাকা নিয়ে) শালিস করছে। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা তার বৈশিষ্ট্য। বিএনপি-জামায়াতের লোকরাই তার এক সুহৃদ। তার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ দিন দিন পঞ্জীভূত হচ্ছে। জানি না কী হয়। ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম লেবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা উপজেলা আওয়ামী লীগ করলেও মেয়রের কাছে কোনো পাত্তা নেই। তিনি তার ইচ্ছামতো জামায়াত-বিএনপি নেতাদের নিয়ে রাজনীতি করছেন আর বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন।

আমি সবার মেয়র : ঘাটাইলের পৌর মেয়র শহীদুজ্জামান শহীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন বটে, কিন্তু তিনি তো শুধু আওয়ামী লীগের মেয়র নন। শহীদ বলেন, আমি দলমত নির্বিশেষে সবার মেয়র। তাই আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি সব নেতারাই থাকতে পারেন। এতে দোষের কিছু দেখি না। তিনি আরও বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধ যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা। আমি এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নই।’

সাংবাদিক নির্যাতনকারী ঘাটাইল পৌর মেয়র শহীদের শাস্তির দাবি :সাংবাদিক নির্যাতনকারী ঘাটাইল পৌরসভার মেয়র শহীদুজ্জামান শহীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন জামালপুরের কর্মরত সাংবাদিকরা। গতকাল জামালপুর জেলা প্রেস ক্লাবে এক প্রতিবাদ সমাবেশে বলা হয় অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে ঘাটাইল পৌর মেয়র শহীদুজ্জামান শহীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনের ঘাটাইল ও নিউজ  টোয়েন্টিফোরের টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি আতিকুর রহমান আতিককে আটকে রেখে যে নির্যাতন করেছে এটা দুর্নীতিবাজ মেয়রের মধ্যযুগীয় মানসিকতার প্রকাশ। সভায় সাংবাদিক নির্যাতনকারী মেয়র শহীদকে তার পদ থেকে অপসারণ এবং তাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান বক্তারা। জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর শফিক জামানের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মুকুল রানা, দৈনিক সংবাদ’র সুশান্ত কানু, দৈনিক আজকের জামালপুর সম্পাদক এম এ জলিল, নিউ এজ’র কামাল হোসেন, ডেইলি স্টার’র আমিনুল ইসলাম লিটন, যমুনা টিভি’র শোয়েব হোসেন, খোলা কাগজ’র ইউসুফ আলী, ডিবিসি নিউজ ও যায়যায়দিন’র শুভ্র মেহেদী, এসএ টিভি’র ফজলে এলাহী মাকাম, বাংলাদেশ টু ডে’র সুলতান আলম, দীপ্ত টিভি’র তানভীর আহমেদ হীরা, মাইটিভি’র শামীম আলম, এশিয়ান টিভি’র শাহীন আল আমীন, নিউজ  টোয়েন্টিফোর’র তানভীর আজাদ মামুন, মানব জমিন’র আনোয়ারুল ইসলাম মিলন, বিজয় টিভি’র জুয়েল রানা, ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউন’র বিশ্বজিৎ দেব, যুগান্তরের সরিষাবাড়ি প্রতিনিধি জহুরুল ইসলাম ঠান্ডু প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর