বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা পরিচয়ে মিয়ানমারে ফিরতে চায় ওরা

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে

বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা তাদের জাতিগত রোহিঙ্গা পরিচয়েই নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। তবে তারা তাদের সব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হতে চায়। চায় নির্ভয়ে বেঁচে থাকার পরিবেশ। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী সব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আন্তর্জাতিক আইনে বিচার চায় তারা। কমপক্ষে ৫০ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে গতকাল কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালীর নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে তাঁবুতে। প্রতিটি তাঁবুতে হাজারো ধরনের সমস্যা ও দুর্ভোগ। ত্রাণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। চালু হয়নি কোনো রেশনিং পদ্ধতি। ফলে কারও কাছে চাল আছে তো ডাল নেই, ডাল আছে তো তেল নেই। খেটে খাওয়া মানুষগুলো দ্রুত ফিরে যেতে চায় তাদের দেশে। টানা অভাব-অনটনের মুখে পড়ার আগেই তারা মিয়ানমারে গিয়ে স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনযাপন শুরু করতে উন্মুখ। মিয়ানমারের মংডু, বুছিদং, রাছিদং থেকে আসা সোনা মিয়া, মোহাম্মদ হোসেন, সাইদুল হক, আবদুল মজিদ, আনোয়ারা বেগম, উম্মে হাবিবা, নূর মোহাম্মদ, মো. একরাম, রাবেয়া বশরী, হালিমা খাতুন এদের প্রত্যেকের প্রায় একই কথা— ‘আমাদের জন্য মিয়ানমারে স্বাধীনভাবে থাকার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করে মগ-মুসলিম পরখ না করে সম অধিকারে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। মিয়ানমারের সব জায়গায় চলাফেরার সুযোগ দিতে হবে।’ রাছিদংয়ের ঝুপারাং থেকে আসা রোহিঙ্গা সোনা মিয়াকে (৪৫) বসে থাকতে দেখা যায় থাইংখালীর একটি অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট্ট তাঁবুতে।

বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। তাঁবুর একদিক দিয়ে ভিতরে পড়ছে বৃষ্টির পানি। বৃদ্ধা অসুস্থ মা, স্ত্রী আর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে অলস বসে আছেন সোনা মিয়া। ঘরের এক কোণে ২ কেজি পরিমাণ আলু ও তিন চারটি পিয়াজও দেখা যায়। বেলা তখন সোয়া ২টা। দুপুরের খাবার হয়েছে কি না, নাকি রান্নার প্রস্তুতি শুরু হবে—জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুপুরে কেউই খাই না, সকালে কোনোরকম খেয়েছি আবার খাব রাত নামলে। তিন বেলা খাওয়ার মতো চাল-ডাল নেই। ১৫ দিন হচ্ছে এখানে এসেছি। ত্রাণ পেয়েছি মাত্র একবার।’

শক্তসামর্থ্য এই রোহিঙ্গা আরও বলেন, ‘আমি মিয়ানমারে সেলাই কাজ ও মিস্ত্রির কাজ করতাম। মোটামুটিভাবে চলে যাচ্ছিল সংসার। তবে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কখনো যেতে পারতাম না। ছেলেমেয়েদের মক্তবে পড়ানো ছাড়া কোনো স্কুলে পড়ানোর সুযোগ পেতাম না। আকিয়াব, রেঙ্গুন এসব শহরের নামই শুনেছি শুধু, কখনো দেখার সুযোগ হয়নি। আমাদের দেশের শহর, অথচ আমরাই এসব এলাকায় যেতে পারি না। এসব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না হলে আমরা মিয়ানমারে আর যাব না। মরতে হলে এখানেই মরব।’

বুছিদংয়ের ওয়ালিং পাড়া থেকে আসা আনোয়ারা বেগম (৪০) জানান, তার ছেলেমেয়ে রয়েছে পাঁচজন। দুজনের জ্বর সর্দি। ঘরে বা তাঁবুতে চাল-ডাল, লাকড়ি কিছুই নেই। তারপরও এখানে প্রাণটা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়— এটাই বড় পাওনা। এ অবস্থায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান কি না—এমন প্রশ্নে আনোয়ারা বলেন, ‘যাইতম ন, বেশি জুলুম চলের। এ অবস্থাত আরা যাইল মারি ফেলাইবু মগঅল। তারতুন এড়ে মরিজন ভালা।’ (যাব না, সেখানে বেশি জুলুম চলছে। এখন আমরা গেলে আমাদের মগরা মেরে ফেলবে। তার চেয়ে এখানে মারা যাওয়া ভালো।)

গতকাল বালুখালীর একটি তাঁবুতে কথা হয় ১৩ বছরের রোহিঙ্গা কিশোরী রাবেয়া বশরীর সঙ্গে। সে বলে, বুছিদংয়ের লাভাদং থেকে মা-বাবার সঙ্গে এখানে চলে আসে। অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ হলে, পড়ালেখা করার অধিকার পেলে সে মিয়ানমারে ফিরে যাবে।

রাছিদংয়ের রাজার বিল থেকে আসা মোহাম্মদ একরাম (৫০) তার ৭ বছরের গুলিবিদ্ধ মেয়ে উম্মে হাবিবাকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই নিষ্পাপ মেয়েটির কী অপরাধ ছিল, তাকে মিয়ানমারের হুকুমত (সেনাবাহিনী) গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। তারপরও আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু আমাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। সব কাজ স্বাধীনভাবে করার সুযোগ দিলে আমরা চলে যাব।’

কুতুপালংয়ে নতুন ক্যাম্পে ৫ দিন ধরে মংডুর উকিলপাড়া থেকে এসেছেন সাহেরা খাতুন নামে এক ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধা। তার সঙ্গে তিন ছেলেও তাদের স্ত্রী ও নাতি-নাতনি মিলে ১৬ জন। দুটি তাঁবু গেড়েছেন কুতুপালং ও বালুখালী সীমানা ঘেঁষে দুই পাহাড়ের পাদদেশে। সেখানে কথা হয় বৃদ্ধার সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, মংডু এলাকায় বর্মিজ আর্মি আর মগেরা গণহত্যা চালিয়েছে। এক থানাতেই অন্তত দেড় দুই লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে যাওয়ার চেয়ে মুসলমান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে মরাই ভালো। 

একই ক্যাম্পে সাইয়্যেদুল হক নামে আরেক রোহিঙ্গা মাওলানার সঙ্গে কথা হয়। তিনি এসেছেন মিয়ানমারের বুছিদং থেকে। সেখানে মগ আর সেনাবাহিনীর দ্বারা মুসলিম রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞের বাস্তব সাক্ষী ছিলেন তিনি। নিজেও মৃত্যুর হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা পেয়েছেন। সাইয়্যেদুল হক জানান, ওই দৃশ্য দেখার পর আর কেউ সেখানে ফিরে যাবে, এটা ভাবাও যায় না। কারণ, সবচেয়ে বেশি  রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে মংডু আর বুছিদংয়ে। চোখের সামনেই কচু কাটার মতো লাশ দেখেছি। বুছিদংয়ে অন্তত দেড় থেকে দুই লাখ মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে বড় অংশই যুবক-যুবতী। এতকিছুর পরও আমি জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চাই, যদি আমাকে প্রাপ্য অধিকার দেওয়া হয়। রোহিঙ্গা মুসলিম হিসেবে পরিচয় পাই। নিজেদের ধন সম্পদসহ সব কিছুই ফিরে পাই।

সর্বশেষ খবর