নীলকুঠি শব্দটি উচ্চারণ করলেই শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে, লোম খাড়া হয়ে যায়। নীলকর ইংরেজ সাহেবদের চাবুকের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত কৃষকের মুখ মনে পড়ে। এমনই দুঃসহ স্মৃতি ধারণ করে আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সোনাইকুন্ডি নীলকুঠি। আজও এলাকার প্রবীণদের মুখে মুখে ফেরে এই নীলকুঠিতে বাংলার কৃষকদের নিপীড়নের লোমহর্ষক কাহিনী।
সোনাইকুন্ডি নীলকুঠির ইতিহাস : ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কুষ্টিয়া (তৎকালীন নদীয়া) জেলার জমি নীল চাষের জন্য খুব উপযোগী ছিল। এ কারণে ইংরেজরা এই অঞ্চলকে নীল চাষের জন্য বেছে নেন। টিআই কেনী, ফারগুসন, ক্রফোর্ড, স্টিভেনসন, সিমসন, সেস, শেলী, ওয়াটস, হেমিল্টন প্রমুখ নীলকরের আধিপত্য ছিল। ১৮১৫ সালে ক্রফোড দৌলতপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সোনাইকুন্ডি গ্রামে একটি নীলকুঠি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সোনাইকুন্ডি নীলকুঠি নামে পরিচিত। ঢেউটিনের ছাউনি দেওয়া এই বিশাল কুঠিবাড়িতে মোট ১২টি কক্ষ রয়েছে। এই নীলকুঠির জমির পরিমাণ ৭.৮০ একর। ২০ ইঞ্চি পুরো ইটের দেয়ালের এই বাড়িটি বর্তমানে উপজেলার হোগলবাড়ীয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। মূল বাড়িটির পাশাপাশি সে সময় রোপণ করা তিনটি ঝাউগাছ আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ঘোড়ার আস্তাবলসহ (ঘোড়া রাখার ঘর) অক্ষত অবস্থায় থাকলেও অনেক স্মৃতি চিহ্ন ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে।
নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী : এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সে সময় ইংরেজ জমিদাররা প্রজা সাধারণকে দিয়ে জোরপূর্বক নীলচাষ করাতেন। এ নীল আবাদের জন্য জমিদার, নীলকর, জোতদার প্রভৃৃতি সামন্ত প্রভুরা প্রজাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতেন। প্রজাদের জমির ওপর কোনো অধিকার ছিল না। চাষিদের নামে দাদন লিখিয়ে কোনো টাকা না দিয়ে তাদের গরু লাঙল দ্বারা নীলচাষ করিয়ে তাদের দ্বারা কেটে পচিয়ে নীল তৈরি করে নিত। অবাধ্য চাষিদের অপহরণ করে হত্যা করত। যার কোনো সংবাদ পাওয়া যেত না। আবার অনেক কৃষককে ধরে এনে চাবুক মেরে জর্জরিত করা হতো। সোনাইকুন্ডির পাশের গ্রাম আল্লার দর্গা হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক অর্জুন কুমার জানান, ‘দাদার মুখে এই সোনাইকুন্ডি নীলকুঠিতে প্রজা নিপীড়নের অনেক করুণ কাহিনী শুনেছি।’ তিনি বলেন, তখন এই অঞ্চলের কৃষকদের প্রধান ফসল ছিল আউশ ধান ও পাট। এই ধান-পাটের মৌসুমেই নীল চাষ করতে তাদের বাধ্য করা হতো। এক বিঘা জমিতে নীল চাষ করতে ১২ টাকা খরচ হলেও নীলকর তাদের মাত্র ৩ টাকা দিতেন।ফলে মৌসুম শেষে একদিকে যেমন কৃষকদের ধানের গোলা ফাঁকা পড়ে থাকত, অন্যদিকে তারা নীল চাষ করে উৎপাদন খরচটাও পেতেন না। এই কারণে কৃষকরা নীল চাষ করতে চাইতেন না। আর এতে কৃষকদের ওপর অমানবিক নির্যাতন নেমে আসত। নীলকর সাহেবরা সে সময় ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতেন। তারা নীল চাষে অবাধ্য কৃষকদের দুহাতে দড়ি বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে টানতে টানতে নিয়ে আসতেন নীলকুঠিতে। সেখানে এনে তাদের ওপর চাবুকের পর চাবুক চালাত। নীল চাষে রাজি হলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হতো। স্থানীয় সংসদ সদস্য সোনাইকুন্ডি গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল হক চৌধুরী বলেন, নীল চাষে রাজি না হওয়ায় তার দাদাকে নীলকুঠিতে ধরে নিয়ে যায় ইংরেজরা। সেখানে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। তবে পরে গ্রামের কৃষকরা একজোট হয়ে নীলকুঠিতে হামলার পরিকল্পনা করলে তার দাদাকে ছেড়ে দেন সাহেবরা।
নীলকুঠির স্মৃতি সংরক্ষণে নয়া উদ্যোগ : ঐতিহ্যবাহী সোনাইকুন্ডি নীলকুঠির স্মৃতি সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মকে বাড়ি সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে এখানে একটি ইকো পার্ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন। এ ইকো পার্কে থাকবে দর্শনার্থীদের জন্য সুইমিং পুল, বসার শেড, লেক, নাগোরদোলা, মোরাল ও ফুলের বাগান। দৌলতপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।