শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রযুক্তির অপব্যবহারে বাড়ছে অপরাধ

মহামারী রূপ নিচ্ছে অনলাইন প্রতারণা, নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি, সাইবার সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি

জিন্নাতুন নূর

দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তি একদিকে যেমন স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে এসেছে অন্যদিকে এর অপব্যবহারের শিকার হয়ে কিছু ব্যবহারকারী আবার আত্মহত্যায় প্ররোচিত হচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারে বর্তমানে অপরাধের ধরনেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। আর অপরাধীরাও অস্ত্র হিসেবে প্রযুক্তিকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে হ্যাকিং, সাইবার বুলিং, অনলাইন কেলেঙ্কারি, প্রতারণা, তথ্য চুরি, নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি, সাইবার সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপরও সামাজিক মিডিয়ার অপরাধ প্রতিরোধে কোনো ফরেনসিক ল্যাব গড়ে ওঠেনি। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা ভুক্তভোগীদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

আতঙ্কের বিষয় এই যে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি ইউটিউব ও মোবাইলে ধারণকৃত ধর্ষণ দৃশ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর এতে একদিকে যেমন ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে এই ঘটনার শিকার ভুক্তভোগী নারী, কিশোরীরা লোকলজ্জার কারণে আত্মহত্যা করছে। বিষয়টি স্বীকার করে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের প্রধান ডিএমপির ডেপুটি কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফেসবুক ও মোবাইলের অপব্যবহারের কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো অপরাধ দিন দিন মহামারী রূপ নিচ্ছে।

এ ছাড়া শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন বীভৎস দৃশ্যও মোবাইলে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। মানুষ এখন নির্যাতনের শিকার শিশুকে না বাঁচিয়ে বরং এই দৃশ্য ভিডিও করতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে, কারণ এই ভিডিও পরবর্তীতে তারা ফেসবুকে আপলোড করছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এই ধরনের আচরণ শিশু নির্যাতনকে আরও উসকে দিচ্ছে।

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, প্রযক্তি সংক্রান্ত অপরাধের জন্য দেশে যে আইন আছে তা বিষেশায়িত নয়। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য কতটা মানুষের সঙ্গে শেয়ার করবেন তা ঠিক করে নিতে হবে। ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠিন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। আর স্পর্শকাতর তথ্য ফেসবুকে শেয়ার না করাই ভালো। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া এখন ‘পারসোনাল মিডিয়া’তে পরিণত হয়েছে। এর খারাপ-ভালো দুটো দিকই আছে। সমাজের কুরুচিপূর্ণ কিছু মানুষ ফেসবুককে খারাপ কাজে ব্যবহার করছেন। ব্লু হোয়েল নামক একটি ইন্টারনেটভিত্তিক গেম নিয়ে সম্প্রতি দেশে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এই খেলাটি নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে বিষয়টিকে আরও ঘোলা করেছেন বলে অভিমত দেন আইটি বিশেষজ্ঞরা। ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে ফেসবুক মেসেঞ্জারে গত বৃহস্পতিবার রাতে একটি খুদে বার্তা পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘১৩ অক্টোবর শুক্রবার রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা বাংলাদেশের সব অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ব্লু হোয়েল গেম ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। যা প্রবেশের ফলে আপনার ফোনের সব ব্যক্তিগত তথ্য, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, আইএমওসহ সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্য শুক্রবার সেই এক ঘণ্টা মোবাইল ফোন বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়। জনসচেতনতায় বিটিআরসি।’ কিন্তু বিটিআরসির পক্ষ থেকে এমন কোনো বার্তা পাঠানো হয়নি বলে সংস্থাটি নিশ্চিত করে। মাদক কেনাবেচার মাধ্যম হিসেবেও অনেকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করছেন। ফেসবুকের বিভিন্ন রেসটিকটেড গ্রুপে যুক্ত হয়ে এর সদস্যরা বিভিন্ন মাদকদ্রব্য  কেনাবেচার মতো অবৈধ কাজও করছে। ফেসবুকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে দেখা করার কথা বলে প্রথম সাক্ষাতেই মেয়েদের ওপর দুর্বৃত্তদের যৌন নির্যাতন করার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্বেগের বিষয় এই যে, অনেক পেজে উসকানিমূলক বক্তব্য ও বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধ বসতিতে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল ফেসবুকের কারণে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এমন বিভ্রান্তিও ছড়িয়ে দেওয়া হয় ফেসবুকে। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে বড় ধরনের হামলা ঘটানো সম্ভব তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনার মাধ্যমে সামনে আসে। এ ছাড়া ক্রেডিট ও ডেবিড কার্ডের পিন আনলক করেও দেশে অর্থ চুরির বহু ঘটনা সামনে এসেছে। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এবং পারিবারিক কলহের অন্যতম কারণ প্রযুক্তি। এজন্য তারা ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে দায়ী করছেন। একইভাবে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টরা প্রযুক্তির অপব্যবহারকে দায়ী করছেন।

সর্বশেষ খবর