রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি বাজারে

দেখার কেউ নেই

জিন্নাতুন নূর

মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি বাজারে

খাদ্যদ্রব্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, নিত্য ব্যবহার্য প্রসাধনী এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীসহ দেশে বিক্রি হওয়া সব পণ্যসামগ্রী নিয়েই ভোক্তারা কমবেশি অসন্তুষ্ট। সঠিক নজরদারি ও তদারকি না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল মেশাচ্ছেন। আর এসব পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব পণ্য একদিকে যেমন মানহীন, অন্যদিকে ভেজাল হওয়ায় তা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যদিও দেশে খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রতিষ্ঠান তিনটির জনবল স্বল্পতাসহ নানা সীমাবদ্ধতার জন্য ভেজাল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় গতকাল দেশব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব মান দিবস। নান্দনিক নগরায়ণে মান প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। এ উপলক্ষে বিএসটিআই এর প্রধান কার্যালয়সহ আঞ্চলিক অফিসগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়।

ভেজাল পণ্যের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা জানান, রাসায়নিক মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য খেয়ে আগের তুলনায় মানুষের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিত্সকরা ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার সমস্যা, আর্সেনিক, স্নায়ু সমস্যা, পাকস্থলী সংক্রমণ, গর্ভজাত সন্তানের প্রতিবন্ধকতা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ইত্যাদি শারীরিক সমস্যার জন্য ভেজাল খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ ও প্রসাধনীর ব্যবহারকে দায়ী করছে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সূত্রে জানা যায়, বিএসটিআই মাত্র ১৫৪টি পণ্য বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করছে। বাকি পণ্যগুলো বাধ্যতামূলক না হওয়ায় অসাধুরা এগুলোতে ভেজাল মেশাচ্ছে। এমনটি ভেজাল পণ্যের ব্যবসায়ীরা কারখানায় বিএসটিআই’র লোগো ব্যবহার করে নকল পণ্য উত্পাদন করছে। আবার অনেকে দোকানে বিশেষ করে ঢাকার আশপাশে ও বাইরে এলাকাগুলোতে বিক্রি হওয়া প্যাকেটজাত খাবার ও ওষুধের মেয়াদ না থাকলেও তা বিক্রি করা হচ্ছে। বিএসটিআইর মহাপরিচালক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএসটিআইর জনবল বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এ ছাড়া বিএসটিআইর বাধ্যতামূলক ১৫৪টি পণ্যের তালিকা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে আমরা দ্রুত বাধ্যতামূলক পণ্যের তালিকা ১৮৪টি করতে পারব। মধুমাস (ফলের মৌসুম) ও রমজান মাস আসলেই শুধু ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালিত হয়। যা বছরের অন্য সময়ে তুলনামূলক কম হয়। আর এর সুযোগ নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে মোবাইল কোর্টের কারণে আগের চেয়ে মৌসুমি ফলে রাসায়নিকের ব্যবহার কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। অসৎ ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টে ঢাকার বাইরে থেকেই এখন ফল এনে তাতে রাসায়নিক মেশাচ্ছেন। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ সংলগ্ন কয়েকজন ফল ব্যবসায়ী জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফল ট্রাকে করে রাজধানীতে আনা হয়। দীর্ঘ যাত্রায় ফলগুলো নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য ফল তাজা রাখতে এতে রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগ করা হয়। ফল ছাড়াও ভেজাল মেশানো হচ্ছে কাঁচা মাছ-মাংসে। বিক্রেতারা গরু ও খাসির নামে নির্বিকারে মহিষ ও ভেড়ার মাংস বিক্রি করছেন। আর মরা মুরগির মাংস চলে যাচ্ছে বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরাঁতে। বিভিন্ন ধরনের মাছে আগের তুলনায় ফরমালিনের ব্যবহার কমলেও পুরোপুরি তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে আরও জানা যায়, চিংড়ি মাছে এখন বেশি ভেজাল মেশানো হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা চিংড়িতে জেলি, সাগু, পানি, পাউডার ও সাদা লোহা ইত্যাদি মিশিয়ে ওজন বৃদ্ধি করে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন।

ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ভেজাল মেশানো হচ্ছে তরল ও গুঁড়ো দুধেও। তরল দুধের বিকল্প কনডেন্সড মিল্কেও অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল মিশিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘ সময় পরও দুধ যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য দুধে ঘনমাত্রার ফরমালিন মেশানো হয়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে বাজারের বিভিন্ন কোম্পানির তরল দুধের নমুনা পরীক্ষা করা হলে এতে অ্যালড্রিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। আর কনডেন্সড মিল্কে মেশানো হয় পাম তেলসহ বিভিন্ন রাসায়নিক। অসাধু ব্যবসায়ীরা স্যাকারিন, আটা-ময়দাসহ বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে তৈরি করছেন ভেজাল গুঁড়ো দুধ। এমনকি রং ও রাসায়নিক মিশিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে চালও। বাজারে বিক্রি হওয়া সরিষার তেলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে কৃত্রিম ঝাঁজ তৈরি করছেন। চিনিতেও দেদার ভেজাল মেশানো হচ্ছে। ঘনচিনির নামে এখন মানুষকে খাওয়ানো হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, সাইট্রিক অ্যাসিড, সোডিয়াম সাইট্রেটের মতো ক্ষতিকর উপাদান। শিশু খাদ্যের বিক্রি ভালো হওয়ায় ভেজাল মেশানো হচ্ছে আইসক্রিমেও। রাজধানীর শনিরআখড়া, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ভেজাল আইসক্রিম তৈরির অসংখ্য কারখানা। এ কারখানার মালিকরা বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়াই তাদের তৈরি করা আইসক্রিমের মোড়কে বিএসটিআইয়ের লোগো ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া নামি কোম্পানির আইসক্রিমের মোড়ক নকল করেও ভেজাল আইসক্রিম তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো তৈরিতে ব্যবহূত হচ্ছে দূষিত পানি, নিম্নমানের গুঁড়ো দুধ, স্যাকারিন, নিম্নমানের সুজি, এরারুট ও কাপড়ে ব্যবহূত রং। এই আইসক্রিমগুলোর বেশিরভাগ প্যাকেটেই তৈরির মেয়াদ পর্যন্ত দেওয়া থাকে না। অধিক মুনাফার জন্য অসাধু ব্যবসায়ী এখন খাবারের গুঁড়ো মসলায় কাপড়ে বিষাক্ত রং, দুর্গন্ধযুক্ত পটকা মরিচের গুঁড়া (নিম্নমানের মরিচ), ধানের তুস, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মোটর ডাল ও সুজি ইত্যাদি মেশাচ্ছেন। এদিকে ভেজাল মসলার বিরুদ্ধে যে অভিযান হচ্ছে তা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলা, ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযান নেই বললেই চলে। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে প্রতিবছরই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে অসংখ্য মৌসুমি সেমাই কারখানা। যার অধিকাংশেরই বিএসটিআই-এর অনুমোদন নেই। সেমাই তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের আটা, পাম তেল, ডালডা ও ক্ষতিকর রং ইত্যাদি। চাহিদা বেশি থাকায় বাজারে বিক্রি হওয়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল প্রসাধনীও তৈরি করা হচ্ছে। ক্যাব-এর তথ্যমতে, বাজারের ৪৫ ভাগ প্রসাধনী পণ্যের বিএসটিআইর সনদ নেই আর ৭৫ ভাগ প্রসাধনীর উত্পাদন প্রতিষ্ঠানের কোনো ঠিকানা নেই। শুধু রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় প্রায় তিন শতাধিকের ওপর নকল প্রসাধনী সামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা থেকে বিভিন্ন হাত ঘুরে নকল প্রসাধনী দেশের বড় সুপার শপ, বিপণিবিতান ও মফস্বল এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে ভেজাল প্রসাধনী তৈরিতে জড়িতদের লঘুদণ্ড দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পর তারা পুনরায় একই কাজে ফিরে যান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর পরিচালক (আইন) ও নির্বাহী ম্যাজিস্টেট এবং সাবেক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগের তুলনায় সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা আবারও খাদ্যদ্রব্য অন্যান্য সামগ্রীতে ভেজাল ও রাসায়নিক পদার্থ মেশাতে শুরু করবেন।

সর্বশেষ খবর